1. successrony@gmail.com : Mehedi Hasan Rony :
  2. arif_rashid@live.com : Arif Rashid : Arif Rashid
  3. meherunnesa3285@gmail.com : Meherun Nesa : Meherun Nesa
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:০৬ পূর্বাহ্ন

কুবলয়- চতুর্থ পর্ব

সিফাত হালিম, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ১০৬১ বার

প্রেমার পিতা জনাব আইজউদ্দীন পেশায় মুহুরী ছিল । প্রাথমিক অবস্থায় সে ছিল নীচু অঞ্চলের চাষী গেরস্হ ঘরের ছেলে । সারা বছর জমি ক্ষেত ডুবে থাকে গলাপানিতে। অজন্মার সাথে অভাব তাদের গৃহে। সে নিজের জেলা ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল খুলনা বিভাগের এই যশোহর জেলা শহরে। একখানা ছাতা বগলে, লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরে আর প্লাস্টিকের নাগরাই পায়ে। একবারে কপর্দকশূণ্য অবস্থা তার। কিন্তু জীবিকার জন্য তাকে সারাদিন মুখের রক্ত তুলে শ্রম করতে হয়নি। এখানে এসে অনায়াসে ভাগ্য খুলে গেছল তার।
আইজউদ্দীনের শিক্ষাগত যোগ্যতা আন্ডার ম্যাট্টিক। শীর্ণদেহের ছোটোখাটো মানুষ, রঙেও কষ্টিকালো। বুদ্ধি ও কৌশলে ছিল অতি ধুরন্দর। প্রথমে সে ধনীগৃহে ছাত্র পড়ানো ধরলো। ছাত্র পড়াতে গিয়ে পসারওয়ালা এক মোক্তার সাহেবের নজরে পড়ে যায়। বলাবাহুল্য মোক্তার সাহেবের বাড়িতে সে অবশ্য কিছুকাল লজিং মাস্টার হিসেবেও ছিল। এই গৃহ থেকেই তার সৌভাগ্যের উদয়।
মাসিক পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে মোক্তার সাহেব তাঁর নিজ দফতরের দলিল-দস্তাবেজ লেখাতে ও ফাইল-পত্র টানাতে তাকে মুহুরী হিসেবে রাখলেন।

আইজউদ্দীন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্র পড়ানো বাদ দিল। নিয়মিত মোক্তার সাহেবের সঙ্গে কোর্টে যাতায়াত ধরেছে। তীক্ষ্ণ ধী-শক্তির অধিকারী আইজউদ্দীন অল্পদিনে অভিজ্ঞতা অর্জন করে হয়ে উঠল পাকা মুহুরী। এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই কাছাকাছি অন্য সকলকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু তার আয় খুব বেশী কিছু নয়। অধিক উপার্জনের আশায় মোক্তার সাহেবের আওতা থেকে বেরিয়ে নিজের পথ প্রশস্ত করতে উদ্যত হয়। স্বাধীনভাবে নিজেই খাতাপত্র নিয়ে বসতে লাগলো কোর্ট সংলগ্ন বটতলায়।
কোর্টে প্রতিদিন বহু লোক সমাগম হয়। দূরদূরান্তের বিভিন্ন পেশার লোকে লোকারণ্য থাকে এখানে। বিষয়-আশয় সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা তাদের। সাধারণত নিরক্ষর দরিদ্র সরল লোকেরাই বেশি ভোগান্তির সম্মুখীন হয়ে ঘুরে কোর্ট-কাছারীতে। কেউ কেউ এই কোর্টে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছে একমাত্র সরলতার কারণে, এরকম উদাহরণ আছে ভুরিভুরি।
ইতোমধ্যে আইজউদ্দীনের অনেক উকিলের সাথে চেনা জানা হয়ে গেছে। অনেকের সঙ্গে তার দহরম মহরম, উঠ – বস, চলাফেরা। আইজউদ্দীন টু-পাইসের বিনিময়ে, বিষয়ের সমস্যা বুঝে ভিন্ন ভিন্ন উকিল মোক্তার ধরিয়ে দিতে লাগল মক্কেলদের। মক্কেলের ভোগান্তি কিছুটা হ্রাস হল তাতে। অন্যদিকে দু’তরফ থেকে টপাটপ বাড়ছে আইজউদ্দীনের আয়। নগদ অর্থ কড়িতে ভরে উঠলো তার লোহার সিন্দুক।
সঞ্চয় পর্যাপ্ত হলে দেশের ভিটেবাড়ি বন্দকি থেকে ছাড়িয়ে ঠিকঠাক করালো। কিছু জমিজমা কিনে দিয়ে রাখলো বর্গাদারের কাছে।

উনিশ শো সাতচল্লিশ সালে দেশ বিভাগের পর জোর গুজবের কারণে এবং পাকিস্তানী কর্তৃক অত্যাচারিত হবার ভয়ে হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে একেবারে তাদের পাততাড়ি গুটাতে যে যেমনি পারল গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এবং দেশত্যাগ করার প্রাক্কালে পৈত্রিক বিষয় আশয়ের সঙ্গে সোনা, কাসা, পিতল, গরু-ছাগল এমনকি ভিটেবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি দিতে লাগলো।
সেইসময় যে সব মুসলমানের হাতে নগদে অর্থকড়ি ছিল, তারাই মহাভাগ্যবান হয়েছিল। এই সুযোগে স্বল্প বা নামমাত্র মূল্যে তারা হিন্দুদের স্হাবর অস্হাবর সহায়-সম্পত্তির মালিক হয়ে বসল। টপাটপ কিনে নিতে লাগলো সেসব। অনেকে তাদের ওপর জোর যার মুলুক তার এই প্রক্রিয়া করে, লুটপাটও হয়েছিল কিছু। আইজউদ্দীনের গৃহে তখন অতুল বৈভব। মওকা বুঝে সুযোগের স্বদব্যবহার করতে থাকলো সে।
যে এলাকায় তার আস্তানা। সেখানকার অধিকাংশ লোক ছিল ভীষণ ভীত, নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের। পাড়ার নানান গলিতে হিন্দু বাবুদের বিঘার উপরে জমিতে এক একটি বাড়ি। সেসব অনেক পুরনো আমলের। সেখান থেকে অনেক বেছে নামকাওয়াস্তে টাকায়, কয়েক কোর জমিতে অবস্হিত বড়ো তিনটি দীঘি সদৃশ পুকুর, নানাবিধ ফলমূলের বাগান, বাঁশের ঝাঁড়, পশুপক্ষী, দুইটি বড়ো ধানের গোলা ও ঢেঁকিসহ বিরাট এক বসতবাটি ক্রয় করে নিল। সেই সাথে ভয়ভীতি দেখিয়ে, বিভিন্ন কায়দায় আইনী প্যাঁচে ফেলে বিনা অর্থে কখনো খুবই স্বল্প মূল্যে হাতিয়ে নিত প্রচুর মাঠান ও চাষাবাদের জমি।
জনশ্রুতি আছে, সম্পত্তি ঠেকাবার নামে তার নিজের ভাই-ভগ্নির তরুণ যুবক সন্তান ও স্বগ্রামের যে সমস্ত পুরুষ লোক তার আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে, তাদেরকে নিয়ে সে এক শক্তিশালী লেঠেল বাহিনী গঠন করেছিল।
এদের মধ্যে তার ভগ্নীর বড়ো পুত্র, সম্পর্কে ভাগ্নের সঙ্গে সে বেশী ঘনিষ্ঠ ছিল। এই ভাগ্নে ছিল তার বাহিনীর প্রধান। সে তার সঙ্গে বসেই সকল দুই নম্বর পরিকল্পনা করত। যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত।
আইজউদ্দীনের নিজের বিবাহযোগ্যা তিনটি কন্যা ছিল। বড়ো কন্যার বিবাহের জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায় না। বড়ো কন্যার কারণে অন্য দুইটিকেও পার করা যাচ্ছে না। কন্যাটি দেখতে কুশ্রী। তাছাড়া, অগাধ ধন সম্পদ থাকলেই বা কি? আইজউদ্দীনের কাজের কারণে পরিবারের দুষ্ট বলে খুঁত লেগে গেছে। এদিকে কন্যার বিবাহের বয়স পেরিয়ে যায়। সে তখন অনেক ভেবে ভাগ্নেকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করিয়ে ফেললো। তারপর প্রচুর জমি ও ধন দিয়ে ভাগ্নেকে বানালো জামাতা ।
যাইহোক, আইজউদ্দীনের লেঠেল বাহিনী পাড়ার মধ্যে একটি আতঙ্ক বিশেষ। তাদের পালোয়ান দেহের গদা গদা চেহারা, বিকট গলার আওয়াজ, লাঠি ঘুরাতে ওস্তাদ। বর্শা বল্লম চালাতে সুপটু। তারা আইজউদ্দীনের ছত্রছায়ায় থেকে নানান অপকর্ম, জোর জবরদস্তি, দাঙ্গা – ফ্যাসাদ ও লুঠতরাজ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল।
অল্প সময়ে অনেক অর্থ ও ভূ সম্পত্তির মালিক হবার দৌলতে আইজউদ্দীন ধনী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করে। কথায় বলে, অর্থ জুটলে কৌলিন্য জোটেনা। আইজউদ্দীনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা চিরন্তন সত্য ছিল। ইতোমধ্যেই সে দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহণ করেছে। তখনকার কালে হাতে একটু বেশি অর্থ সম্পত্তি হলেই সম্পদ রক্ষার অছিলায় এবং অধিক সংখ্যক সন্তান লাভের জন্য মুসলিমদের মধ্যে দূই তিনটি বৌ রাখার বাতিক ছিল। আইজউদ্দীনের ভূ-সম্পত্তি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সে এই নিয়মের ব্যাতিক্রম থাকবে কেন ?
চলবে………

এ জাতীয় আরো সংবাদ