নিজের কারামুক্তি ইস্যুতে কোনও ধরনের আন্দোলনে সম্মতি নেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। দলের সিনিয়র ও মধ্যম সারির নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলের পক্ষ থেকে ক্রমাগত কর্মসূচির চাপ থাকলেও রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের বিরুদ্ধে এখনও তার অবস্থান। শিগগিরই তার এই মনোভাবে পরিবর্তন আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নিজের এই অবস্থানের কথা তিনি নিয়মিত পৌঁছেও দিচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে। দলের হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ ও স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপের সময় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও সতর্ক অবস্থানে থাকার চিন্তা-ভাবনা করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। কমিটির প্রভাবশালী কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতাদের গ্রেফতার ও দ্রব্যমূল্যের হঠাৎ ঊর্ধ্বগতির নেপথ্যে কী, তা নিশ্চিত হতে পারছে না বিএনপি। এক্ষেত্রে বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারকের আশঙ্কা, পরিস্থিতি স্পষ্ট না বুঝে উদ্যোগ নিলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর গুলশানে বসছে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক। এই বৈঠকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
বিএনপি হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল জানান, শুধু আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে বের করা যাবে, এমন কৌশলে বিশ্বাসী নয় দলের হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে প্রধান নির্দেশনা হিসেবে কাজ করছে বিএনপি-প্রধানের বক্তব্যই। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার আগে প্রকাশ্যে ও ঘরোয়া—উভয় ক্ষেত্রেই যেকোনও পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের শান্ত থেকে ষড়যন্ত্র মোকাবিলার কথা বলেছেন খালেদা জিয়া।
এরআগে, ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত দলের নির্বাহী কমিটির সভায় ও ৭ ফেব্রুয়ারি গুলশানে নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়েই প্রতিহিংসামূলক আচরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি প্রধান।
দলটির হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ এক নেতা বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) রাতে বলেন, ‘খালেদা জিয়া নিজের মুক্তির আন্দোলনের বিপক্ষে বলেছেন। এছাড়া পরবর্তী সময়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও পরিবারের সদস্যরা যখনই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, সব সময়ই খালেদা জিয়া বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন।’
কারামুক্তি ও আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রায় একই বক্তব্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদেরও। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া যেভাবে বলেছেন, আমরা সেভাবেই অনুসরণ করছি। আমরা যদি রাস্তায় নামি, তখন সরকারই সহিংসতা সৃষ্টি করবে।’
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক প্রভাবশালী সদস্যও। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় নামলে পুলিশ ধরবে, মামলা হবে, এখন এই ঝুঁকি কেন আমরা নিতে যাবো? এক্ষেত্রে আমরা নতুন কোনও কৌশলে যাবো কিনা, তা নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার ওপর। তিনি কী চান, আমরা সেটা জেনেই বাস্তবায়ন করবো।’
বিএনপি হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীল জানান, ইতোমধ্যে দলের প্রায় ২০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। নতুন করে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার করার পরিস্থিতি তৈরি করার বিরুদ্ধে হাইকমান্ড। তাই পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ছাড়া নতুন করে ঘরোয়া কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে মুক্তি দাবির প্রক্রিয়াও।’
দলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। যে লোকগুলোকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের কেউ-ই সরকারের প্রতিপক্ষ ছিলেন না। দৃশ্যত সরকারের দায়িত্বশীলরা ‘দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের’ কথা বললেও আদতে এর পেছনের কারণ ভিন্ন। যার কোনও কূল এখনও বিএনপির কাছে স্পষ্ট হয়নি। ফলে, যেখানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও অস্বস্তিতে আছে, সেখানে বিএনপির উদ্যোগ সফল হবে—এমন কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং স্যাবোটাজ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও সূত্রটি জানায়।
দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য সক্রিয় কর্মসূচি দিতে বিএনপির মধ্যম সারির ও সিনিয়র নেতারা প্রায়ই বক্তব্য দেন। শুক্রবারও (১৫ নভেম্বর) ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আক্রমণাত্মক রাজনীতি করলে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আত্মরক্ষামূলক রাজনীতি করে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিএনপির রাজনীতি এখন হয়ে উঠেছে আত্মরক্ষামূলক রাজনীতি।’ যদিও দলের নীতি নিয়ে কাজ করেন, এমন নেতাদের দৃষ্টিতে তা ‘অতি-উৎসাহ’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এমন একাধিক দায়িত্বশীল জানান, দলের হাইকমান্ড সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই কর্মসূচিতে সক্রিয় হওয়ার পক্ষে। এখন সারাদেশের কমিটিগুলো পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এই কমিটিগুলো সরাসরি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘প্রশাসন অনুমতি দিলে মিটিং হবে, না দিলে হবে না। এটি আপাতত এভাবেই চলবে।’ এই সদস্যের দাবি, কারাগারে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া জামায়াতের কয়েকজন নেতাকেও এ বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা সহিংস হবেন না।’ সহিংস আন্দোলনের কথা খালেদা জিয়া বলেননি, তারেক রহমানও বলেননি।’’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমাদের দলের চেয়ারপারসন সহিংস আন্দোলনের পক্ষে কোনও দিনই ছিলেন না।’
কিন্তু দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা থাকার পরও সিনিয়র ও মধ্যম সারির নেতারা কেন আন্দোলনের বিষয়ে কর্মীদের উত্তেজিত করেন, এমন প্রশ্নে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সূত্রটির ভাষ্য, ‘কেন সমন্বিতভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করা যাচ্ছে না, বিষয়টি সত্যি পরিষ্কার নয়।’
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বিএনপির রাজনীতির পর্যবেক্ষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘লন্ডনে বসে তারেক রহমান নিজে যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন, তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। শুনেছি, তিনি একজনের মাধ্যমেই সব খবর নেন।’
এদিকে, শনিবার (১৬ নভেম্বর) বিকাল ৪টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান।
এই প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, বৈঠকে দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলবে। এতে সদ্য প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকাকে নিয়ে শোক প্রকাশ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এটি আমাদের নিয়মিত মিটিং। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কথাবার্তা হবে।’
স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দলের নেতা মাহবুবুর রহমান, এম মোরশেদ খানসহ বেশ কয়েকজন নেতার অসন্তোষ সম্পর্কে কোনও কোনও সদস্য প্রসঙ্গ তুললেও তা এজেন্ডা হিসেবে বৈঠকে স্থান পাবে না। তবে পেঁয়াজ ও চালের মূল্য বাড়ানোর ইস্যুসহ নাগরিক কিছু বিষয়ে জোরালো অবস্থান নেবে বিএনপি। এক্ষেত্রে ন্যূনতম কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে বৈঠকে।
এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে জিয়াউর রহমানকে দোষারোপ করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই বিষয়টিও আলোচ্যসূচিতে থাকতে পারে। বৈঠক শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিয়মিত ব্রিফ করতে পারেন।
সুত্র : বাংলা ট্রিবিউন