1. successrony@gmail.com : Mehedi Hasan Rony :
  2. arif_rashid@live.com : Arif Rashid : Arif Rashid
  3. meherunnesa3285@gmail.com : Meherun Nesa : Meherun Nesa
বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪, ১০:০৫ অপরাহ্ন

আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি: চাকমা

তথ্য সুত্রঃ রোয়ার মিডিয়া
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৯
  • ১০০৪ বার

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির পীঠস্থান। পাহাড়, ঝর্ণা এবং সবুজ অরণ্য মিলিয়ে যেন প্রকৃতির বিস্ময়কর লীলাক্ষেত্র। দেশের মোট আদিবাসীর বেশিরভাগের বসবাস এখানে। সাধারণভাবে নিজেদের জুম্ম জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ তাদের। ভিন্ন ভাষাভাষী সেই সব আদিবাসীদের মধ্যে বিশেষ অবস্থান করে আছে চাকমারা।

রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে সবচেয়ে বেশি এবং কক্সবাজারে টেকনাফের অন্তত ১১টি স্থানে চাকমাদের অবস্থান। বাংলা কিংবা ইংরেজিতে চাকমা বলা হলেও মূলত তা ‘চাঙমা’ শব্দের রূপান্তরিত উচ্চারণ। নিজেদের তারা ভিন্ন উচ্চারণে চাঙমা বলেই পরিচয় দেয়। অন্যান্য আদিবাসীদের দ্বারা ডাকা নামেও আছে ভিন্নতা। কখনো সাক, কখনো আচাক, আইএং, তাকাম কিংবা দৈননাকের মতো আরো নানা নামে যা বোঝায়, তা মূলত চাকমা আদিবাসীদেরই নির্দেশ করে।

কিংবদন্তি অথবা ইতিহাস
চম্পকনগরের রাজা সাধেংগিরির দুই পুত্র বিজয়গিরি ও সমরগিরি। দুর্দান্ত এক অভিযানে বিজয়গিরি চট্টগ্রাম ও আরাকান বিজয় করলেন; আর সেই মুহূর্তেই শুনতে পেলেন দুঃসংবাদ। পিতার মৃত্যু হয়েছে আর মসনদ দখল করেছে ছোট ভাই সমরগিরি। মর্মাহত রাজপুত্র আর প্রাসাদের না ফিরে অনুগত সৈন্যদের নিয়ে থেকে যান এখানেই। সেখান থেকে সাপ্রেইকুল নামক স্থানে গিয়ে স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে থিতু হবার অনুমতি প্রদান করেন সৈন্যদের। কালের ব্যবধানে চম্পকনগরের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। চাকমা ধারণামতে, তারা সেই থেকে যাওয়া বিজয়ী সৈন্যদের বংশধর।

চাকমাদের শাক্যবংশীয় মনে করতো কেউ কেউ। খুব সম্ভবত এ কারণেই সাক বা থেগ নামে অভিহিত করা হতো তাদের। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর আগেই শাক্যরা ভারতে কোনঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। কালের বিবর্তনে চলে যেতে থাকে বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং মালয়ে। তাদেরই একটা অংশ ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে।

কিংবদন্তি ঘেঁটে মনে হয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কাছে কোথাও ছিল চম্পকনগর। আর রামুর দুই মাইল দূরে বাকখালী নদীর তীরে আছে চাকমাকূল নামক স্থান। এই চাকমাকূলই কিংবদন্তি নায়ক বিজয়গিরির সাপ্রেইকুল। যদি সেটাই সত্য হয়; তবে বিজয়গিরি তার বাহিনী নিয়ে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত অধিকার করেছিলেন।

বিজয়গিরির শাসনকাল ৬১৫ থেকে ৬৪৫ সাল। তাকেই যদি প্রথম রাজা ধরা হয়; তবে ৩২/৩৩ তম রাজা ছিলেন অরুণযুগ (ইয়াংজ)। তার শাসনকাল ১৩১৬ থেকে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের হাতে কখনো চাকোমাস আবার কখনো চাডমা নামে উদ্ধৃত হয়েছে তাদের কথা। তবে চাকমাদের উপর আরাকানিদের প্রভাব ছিল তীব্র। সেই প্রভাব কমে আসে রাজা থুধম্মা (১৬৫২-১৬৮৪) এর মৃত্যুর পর থেকে।

১৭১৩ সালে রাজা জল্লীল খান চাকমা শাসনে নতুন স্রোত আনলেন। প্রয়োজনীয় দ্রব্যকে সহজলভ্য করার জন্য তিনি উপহার ও পত্র প্রেরণ করেন মোগলদের কাছে। মোগল আর চাকমা এভাবেই পরস্পরের কাছে এসেছিল। কিন্তু কথায় আছে, বাঘে-মহিষে বন্ধুত্ব হয় না। মোগলদের আধিপত্যকামীতার জন্য সম্পর্ক বেশিদূর এগিয়ে আসতে পারেনি। তবে ব্রিটিশ শাসনের আগপর্যন্ত চাকমা তথা জুম্ম রাজন্যবর্গ ছিল কার্যত স্বাধীন ও সার্বভৌম।

পলাশী যুদ্ধের পর ১৭৭৭ সালে ইংরেজরা প্রথম নজর দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে। এবছর তাদের প্রেরিত অভিযান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় চাকমা সেনাপতি রুনু খানের কাছে। একের পর এক সংঘর্ষ হয় ১৭৮৩, ১৭৮৪ এবং ১৭৮৫ সালে। ইতিহাসে তুলা যুদ্ধ নামে পরিচিত এসব সংঘর্ষে বারবার ব্যর্থ হয় ইংরেজ। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী সকল জায়গাতেই থাকে। ১৭৮৭ সালে কয়েকজন অভিজাত ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে দুর্বল হয়ে চাকমা রাজা ইংরেজদের সাথে সমঝোতামূলক চুক্তিতে আসতে বাধ্য হন। সেদিন থেকেই প্রত্যাশার আকাশে জমতে শুরু করলো মেঘ। ১৭৯১ সালে কার্পাসের বদলে টাকায় কর নেয়া শুরু করে ব্রিটিশরা।

‘ডিভাইড এন্ড রুল’- ব্রিটিশদের এই কুখ্যাত নীতি চাকমাদের উপরও পড়ে। ১৮৭১ সালে বোমাং সার্কেল এবং ১৮৮৪ সালে মং সার্কেল গঠন করার পেছনে ছিল চাকমা রাজ্যকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে ফেলার অজুহাত। দেশভাগের সময় অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হিসাবে ভারতে যুক্ত হবার দাবি উঠলেও যুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সাথে।

পাকিস্তানী আমলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল তরুণ ও বৃদ্ধরা। অসহযোগ আন্দোলনের সময় জুম্ম জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে অচল করে দেয়া হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ (ইপিআর) এ চাকমাদের প্রায় সবাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যাদের অনেকেরই খোঁজ পাওয়া গেছে; অনেকে হারিয়েছে জীবন। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে নিয়ে সমালোচনা হলেও তার চাচা কোকনদাক্ষ রায়ই ত্রিপুরা গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে।

জনসংখ্যা
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে আদম শুমারি হয়। সে মতে, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙামাটি মিলিয়ে মোট চাকমা আদিবাসী জনসংখ্যা ২,৩৯,৪১৭ জন। ১৯৯১ সালের পরে থেকে জাতিভিত্তিক গণনা না থাকায় চাকমাদের মোট সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি। বিশিষ্ট চাকমা ঐতিহাসিক সুগত চাকমার মতানুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে বসবাসকারী চাকমাদের জনসংখ্যা তিন লক্ষ। তারপরেও কেউ কেউ আরো বাড়িয়ে প্রায় চার লাখ বলে দাবি করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদমশুমারি ভিত্তিক চাকমা জনসংখ্যা নিম্নরূপে তালিকায় সাজানো যেতে পারে-

পরিবার ও গোত্র
চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও পুরুষদের প্রাধান্য থাকে। বিয়ের পরে মেয়েরা স্বামীর পরিবারের সদস্য বলে গণ্য হয়। একসময় যৌথ পরিবার দৃশ্যমান থাকলেও বর্তমানে একক পরিবার প্রাধান্য লাভ করেছে। পিতা-মাতা জীবনের শেষ দিকটা অতিবাহিত করে পুত্রের ঘরেই।

সমাজে পিতার সূত্র ধরেই গঠিত হয় গোত্র। চাকমা ভাষায় গোষ্ঠীকে গঝা এবং গোত্রকে গুত্থি বলা হয়। কয়েকটি গুত্থি নিয়ে গঠিত হয় গঝা। গঝার সংখ্যা ত্রিশের অধিক, আর গুত্থির সংখ্যা অর্ধশত। অতীতে দলপতিদের কেন্দ্র করে গঝাগুলি গঠিত হয়েছে। পরে বসতি অঞ্চল বা নদীর নাম অনুসারে সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। নিম্নে বৈশিষ্ট্য সমেত কয়েকটি গঝার নাম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হলো-

অতীতের পদ

ধাবেং (গভর্নর)

চেগে (সেনা অফিসার)

লচ্চর (লস্কর)

স্থানের নাম

তৈন্যা (তৈনছড়ি তীরবাসী)

মুলিমা (মাতামুহুরী তীরবাসী)

ফাকসা (ফাস্যাখালী তীরবাসী)

টোটেম ধারণা

বগা (বক-গঝা)

তদেগা (টিয়া-গঝা)

কুদুগো (সজারু-গজা)

ব্যক্তিজীবন ও আচার
সাধারণত স্বামীর ঘরেই সন্তান জন্ম নেয়। তা সম্ভব না হলে নির্মাণ করে দিতে হয় পৃথক ঘর। আগে ‘ওঝারাই’ বা বিশেষ ধাত্রী থাকলেও বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আধুনিক পদ্ধতি নেয়া হয়। সন্তান জন্মের সাথে সাথে মুখে মধু দেয়া হয় জীবন মধুময় হয়ে উঠার প্রত্যাশায়। নবজাতকের নাভী ছেড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আয়োজন করা হয় ‘কোজোই পানি লনা’ নামে বিশেষ অনুষ্ঠান। ওঝা ডেকে ‘ঘিলে-কোজোই-পানি’ বা বিশুদ্ধ পানি দিয়ে শিশুর চুল ধুয়ে পবিত্র করা হয়। সামান্য খানাপিনা এবং সেই সাথে নেয়া হয় ওঝাকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা। শিশুর মাথা মুড়িয়ে দেয়াকে তাদের ভাষায় বলে ‘বিষচুল মুরানা’।

বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত এক স্বামী এক স্ত্রীই দেখা যায়। অভিজাতদের মধ্যে সীমিত সংখ্যায় একাধিক স্ত্রীর পরিবার আছে। সেই সাথে আছে বিধবা বিবাহের প্রথা। মামাতো, খালাতো কিংবা অনাত্মীয় কাউকে বিয়ে করা গেলেও কাকাতো বা জেঠাতো বোনকে বিয়ে করা যায় না চাকমা বিধি মতে। বিয়ের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি বেশ প্রচলিত। অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে আগে সুপ্রচলিত ছিল, দিনকে দিন তা হ্রাস পাচ্ছে। পাত্র এবং পাত্রীর পছন্দ আর সেই সাথে অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে বিয়েটা বেশ জনপ্রিয়।

অভিভাবকের অমত থাকলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করাও বৈধ। সালিশে পিতা-মাতা অমত হলে মেয়েকে ফেরত পায়। তবে তৃতীয়বারের মাথায় পলায়ন করলে আর ফেরত পাওয়া যায় না। এই রীতি বর্তমানে নেই বললেই চলে। একই অবস্থা জোরপূর্বক বিয়ের জন্যও।

পাত্রের বাবাকে পাত্রীর বাবার কাছে বিয়ের আগেই অন্তত তিনবার যেতে হয় উপহার সমেত। দিন তারিখ ঠিক করতে মদ নিয়ে যাওয়াকে বলা হয় মদপিলাং। বিয়ের দিন শুভক্ষণ দেখে পাত্রপক্ষ উপহার নিয়ে হাজির হয়। কন্যাকে তুলে দেবার আগে বিশেষ আশির্বাদ দেয়া হয় চাল ও তুলা দিয়ে। বিয়ের মূল পর্বের শুরু মূলত বরের বাড়িতে। পবিত্র পানি সংগ্রহ এবং পাতা ভাসানো, বউকে বরের বাড়িতে তুলে আনা, জরাবানা বা বর ও কনেকে পাশাপাশি আসনে বসিয়ে জোড়া বেঁধে দেয়া, চুঙুলাং বা দেবদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ এবং বিসুত ভাঙানা বা তিনদিনের মধ্যে বরকে বউসহ শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কমপক্ষে একরাত যাপন করা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হিসেবে প্রচলিত। তবে আজকাল বিয়েতে নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুর দ্বারা বিয়ে, আংটি ও মালা বদলের মাধ্যমে বিয়ে আর শিক্ষিত সমাজে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।

চাকমারা মৃতদেহকে দাহ করে। তবে বুধবারে মৃতদেহ দাহ করা হয় না। মৃত্যু হলে ভিক্ষুকে খবর দেয়া এবং বিশেষ আচারের মাধ্যমে শবদেহকে চিতায় নিয়ে যাওয়া হয়। দাহের সপ্তম দিনে আবার ভিক্ষু ঢেকে মৃতের সদগতি ও পরিবারের শান্তি কামনা করে ধর্মসূত্র ও দেশনা শ্রবণ করে। অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় সাদ্দিন্যা। এছাড়া মৃত্যুবার্ষিকী হিসেবে পালিত হয় বোঝোরী।

চাকমা নারীর পোশাকের মধ্যে নিচে পরার জন্য পিনোন, বক্ষ বন্ধনীর জন্য খাদি আর সেই সাথে কাগই এবং পাগড়ি উল্লেখযোগ্য। কাপড় তৈরির জন্য বিশেষ প্রকারের তাঁত আছে; যার নাম বেইন। অলংকারের মধ্যে নাকে নাকফুল, গলায় হালছরা, বাহুতে হাসুলি, কানে ঝুমুলি, পায়ে থেংখারুর মতো সোনা, রূপা এবং হাতির দাঁতে নির্মিত রকমারি অলংকারে চাকমা নারীর সৌন্দর্য সচেতনতা প্রকাশ করে। ঘরে শোভা পায় বাঁশ এবং বেতের তৈরি আসবাবপত্র। খুব সম্ভবত চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী রান্না সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত। সিদোল, ফুজি, এবং সাবারাং চাকমা সমাজে প্রিয় মসলা হিসেবে পরিচিত।

প্রচলিত খেলার পাশাপাশি নিজস্ব কিছু ইনডোর এবং আউটডোর খেলা আছে চাকমাদের মাঝে। ঘিলা খারা, নাদেং খারা, পাঝা খারা এবং কাত্তোল খারা খেলা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।

ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কার
চাকমারা মূলত বৌদ্ধধর্মের হীনযান মতবাদ অনুসরণ করে। আঘরতারা নামে প্রাচীন এক ধর্মগ্রন্থের হদিসও পাওয়া যায়, যাতে ২৮টির মতো সূত্র আছে বলে মনে করা হয়। আগে লুরি বা বৌদ্ধভিক্ষুর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হতো। আধুনিক সময়ে তাদের প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছে। বৌদ্ধ ধর্মের মতো তাদের ভেতরেও ধর্মীয় উৎসবাদি উদযাপিত হয়। কঠিন চীবর দান, বৈশাখী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, ওয়া ধরানা, ওয়া ভাঙানা, ব্যুহ চক্র, ফানাস বাত্তি উড়ানা, গাড়ি টানা, আহজার বাত্তি জ্বালানা, এবং মহাসংঘ দানের মতো উৎসবগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে, তাদের বিশ্বাসে নানা দেবতা এবং অপদেবতার প্রভাবও বিদ্যমান।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দিকে কোনো কোনো চাকমা পরিবারে হিন্দুদের পূজার ধারণা প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে ভাতদ্যা পূজা, থানমানা পূজা, ধর্মকাম, মা লক্ষ্মীমা পূজা, শিজি পূজা প্রভৃতির প্রাধান্য একসময় ছিলো। তবে মূলধারা থেকে এদের একরকম বিলুপ্তি ঘটেছে অনেক আগেই।

প্রতি আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ পালিত হয় হাল-পালনি। ঐশ্বর্যের দেবী মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় মুরগি এবং ডিমসহ ভাত। মদ, পাজন এবং নানা খাবারের আয়োজন থাকে বাড়িতে বাড়িতে। আবার কোনো গৃহস্থ ফসল কাটার মতো বড় কোনো কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইলে অন্যান্যদের সাহায্য কামনা করে। একে বলে মালেইয়া-দাগানা বা দশের সাহায্য চাওয়া। পারস্পারিক সহযোগিতায় কাজ শেষ হলে তাদের মজুরির বদলে বড় একটা ভোজের আয়োজন করে খাইয়ে দিতে হয়। অস্বচ্ছল হলে ভোজ দেবার প্রয়োজন হয় না। সন্তান প্রসবের পর আত্মীয়-স্বজনেরা নানা কিছু রেঁধে প্রসূতিকে দিয়ে যায়। এই প্রথা ভাতমঝা দেনা নামে পরিচিত।

সামাজিক উৎসবের মধ্যে বৃহত্তম বিজু উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই বিভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে। বাংলা বর্ষের শেষ দুদিন এবং নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ তিন দিন জুড়ে এর বিস্তৃতি। প্রথম দিন পরিচিত ফুলবিজু নামে। তরুণ-তরুণীরা ভোরের দিকে নানা রকমের ফুল সংগ্রহ করে আনে এবং বাড়ির আঙিনা পরিস্কার করে সাজায়। বুদ্ধের উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন এবং সন্ধ্যায় বাতি প্রজ্বলন করা হয়। দ্বিতীয় দিন মূল বিজু- জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে দরজা। দিনব্যাপী নানা আয়োজনের সাথে থাকে ঐতিহ্যবাহী হরেক খাবারের সমাহার। পবিত্র হবার প্রতীক হিসাবে তরুণ-তরুণীরা গোসল করিয়ে দেন বৃদ্ধদের। গোজ্যাপোজ্যা নামে স্বীকৃত শেষদিন পালিত হয় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে। কিয়াঙ বা আঙিনায় আমন্ত্রণ করা হয় ভিক্ষু।

ভাষা ও লোকসংস্কৃতি
কারো কারো মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীদের ভাষাগুলোর মধ্যে কেবল চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ইন্দো-ইরানীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য বাংলা, হিন্দি, অসমীয়ার প্রভৃতি ভাষার সাথে চাকমা ভাষার মৌলিক শব্দগুলোর ধ্বনিগত, অর্থগত এবং রূপগত সাদৃশ্য বিদ্যমান। তবে, অনেকেই সিনো-তিবেতিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে চাকমা ভাষাকে সনাক্ত করেন। চাকমাদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, তাদের ভাষায় বিদ্যমান ধ্বনিসমূহ এবং বর্ণের ব্যবহারকে তারা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। সেই সাথে পালি, সংস্কৃত, আরাকানি, বর্মী, পাংখোয়া, পর্তুগিজসহ অন্যান্য বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ এসেছে বলে জানা যায়।

চাকমা বর্ণমালায় ওঝা এবং বৈদ্যরা প্রাচীন অজস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। ওঝাদের লিখিত বর্ণমালা অঝা-পাঠ নামে পরিচিত। এতে বর্ণ সংখ্যা ৩৩। যদিও সুগত চাকমা প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে মত প্রকাশ করেছেন। চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা অনেক পুরোনো হলেও বেশিরভাগ সময় লেখা হয়েছে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে।

প্রাচীনকাল থেকেই চাকমারা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অধিকারী। গত শতকের সত্তরের দশক থেকে আধুনিক চাকমা গান, কবিতা, গল্পের উল্লেখযোগ্য বিকাশ শুরু হয়। জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর, গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী, মুড়োল্যা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রভৃতি এসব ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রাখে। গান এবং সুরের ক্ষেত্রের তাদের স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। একটি প্রবাদ নিম্নরূপ-

চাকমা ভাষায়,

লোগ মুয়ত জয় লোগ মুয়ত খয়
ভাত ভালা চুধা খা, পথ ভালা বেঙা যা,
আমনত্তুন থেলে খা, পরত্তুন থেলে চা
লাভে লুয়া বয়, অলাভে তুলায়্য ন বুয়ায়।

বাংলায় রূপান্তর,

লোকের মুখে জয়, লোকের মুখে ক্ষয়
ভাত ভালো তরকারি ছাড়াই খাওয়া যায়; পথ ভালো বাঁকাতেও চলা যায়;
নিজের থাকলে খাও, পরের থাকলে চাও
লাভে লোহা বহন করে, বিনা লাভে তুলাও বহন করেনা।
(বাংলাদেশের আদিবাসী, উৎস প্রকাশন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৩৭)

সংগঠন ও অন্যান্য
সকল জুম্ম জনগোষ্ঠীর জন্যই সামাজিক, প্রশাসনিক এবং বিচার বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। সার্কেলের প্রধানকে বলা হয় রাজা। প্রথমত, তিনি গ্রামের ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখেন এবং প্রথা অনুযায়ী বিচার করেন। আদিবাসীদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া নিয়ে জেলা পরিষদে যোগ দেন। পরামর্শ দেন প্রশাসনকে।

কৃষিভিত্তিক সমাজ হবার কারণে অর্থনীতি মূলত ভূমিনির্ভর। বহু পুরুষ ধরে বসবাস করার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিতে তাদের একটা আলাদা সম্পর্ক এবং অধিকার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কেউ জুমচাষী, কেউ লাঙল চাষী আবার কেউ উদ্যান চাষী। তবে ইদানিং ইপিজেড এলাকায় কিংবা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা এবং চাকরিতে তাদের প্রবেশ উল্লেখযোগ্য হারে দেখা যাচ্ছে।

১৯১৫ সালে ‘চাকমা যুবক সমিতি’ এবং ১৯২০ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি’-এর প্রতিষ্ঠা তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কামিনী মোহন দেওয়ান এবং ১৯৬২ সালের নির্বাচনে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় পরিষদে রাজা ত্রিদিব রায় এবং প্রাদেশিক পরিষদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও অং শৈ প্রু চৌধুরি।

চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে নিয়ে সমালোচনা হয়। মনে রাখা দরকার, ত্রিদিব রায় নিজ জাতির স্বাতন্ত্র্য নষ্টের ভয়েই পাকিস্তানকে সমর্থন দেন সেই সময়। পরে বাংলাদেশের জন্ম হলে পাকিস্তানে গমন করে থিতু হন এবং ইসলামাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার দায় গোটা গোষ্ঠীর উপর বর্তায় না। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এবং গাজি অজস্র চাকমা আছেন। ত্রিদিব রায়ের চাচা কোকনদাক্ষও তাদের একজন।

স্বাধীনতার পর থেকে স্বতন্ত্র নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। সেই আলোকে সম্মিলিত আন্দোলনে নামে ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগোষ্ঠী। বাস্তবিক অর্থেই এম.এন. লারমা ছিলেন জুম্ম জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার অভিভাবকের মতো।

ফুলের ভিন্নতা বাগানে বৈচিত্র্য আনে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্যও কথাটা সমানভাবে সত্য। তাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, ইতিহাসের স্বাতন্ত্র্য এবং অধিকার অক্ষুন্ন রাখার জন্য দেশের মূলধারার সংস্কৃতিই জায়গা করে দিতে পারে। রক্ষা করতে পারে দীর্ঘদিনের জীবনাচারকে।

এ জাতীয় আরো সংবাদ