অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে প্রেমা দেখতে মোটামুটি। শ্যামলা রঙ, চাপা নাক, মাঝারি গড়নের মোটাসোটা। পড়াশুনোয় ভালো না। ও ভালো গান করে। তরুণী বয়সে প্রেমার বিয়ে হয়ে গেল। যারা স্ত্রী জাতিকে শুধুমাত্র ভোগের সামগ্রী মনে করে এসেছে, কন্যা জায়া জননী ভাবতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, প্রেমার স্বামী নামক পুরুষটি ছিল সেই দলভূক্ত।সে পৌরুষের কর্তৃত্বে বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে প্রেমাকে মাদকাসক্ত বানিয়ে নিঙড়ে নিঃশেষিত করে ভয়ানক মরণের এক পথে ঠেলে দিয়েছিল। ততদিনে তাদের ঘরে এসে গেছে দুইটি সন্তান। প্রেমার স্বামী জামিলুর রহমান ওরফে জামিল। বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। জামিল শিক্ষিত। কথা আচরণে ভদ্রলোক। কিন্তু স্বভাবে উল্টো। জামিল ড্রাকুলা টাইপের নারী রক্তশোষক, মদ্যপ ও বিকৃত মস্তিষ্কের যৌনাচারী। মদ, মেয়েমানুষ আর জুয়া নিয়ে কারবার। তার আরো একটা পরিচয় আছে। পেশায় মধ্যম পদের সরকারী চাকুরে। কিন্তু সরকারী অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রটি ছিল রমরমা।বন বিভাগের চাকরি। জামিলের হাতে চোরাই বনজ সম্পদ বিক্রির অঢেল কাঁচা টাকা। রাতারাতি ধনী। তার বিত্ত বৈভবের জীবন যাপন। জামিলের বদলির চাকরি। ক্ষেত্র পাহাড় বনাঞ্চলের এ রেঞ্জ থেকে সে রেঞ্জ। অধিকাংশ সময় তাকে কাটাতে হয় গহীন বনে। থাকে বিভাগের বাংলোয়। প্রেমা বাচ্চাদের লেখাপড়া ও স্কুলের সুবিধার্থে থাকতো শহরের উপর জামিলের তৈরী বাড়িতে। জামিল ছুটিছাটায় বাড়িতে আসে। জায়গা বুঝে কখনো বা প্রেমাও যাতায়াত করে জামিলের কর্মস্থলে। দুই তিন মাসে স্বামী স্ত্রীর দেখা হয় একবার। অবশ্য এতে সুবিধা হয়েছে প্রেমার। জামিল কর্তৃক শারীরিক অত্যাচারে মানসিক রোগগ্রস্হা হয়ে প্রেমা একা একা থাকাকেই অধিক বাঞ্চনীয় মনে করতো।
কিশোরী বয়সের উচ্ছ্বাস চপলতা আর আনন্দ নিয়ে প্রেমার যৌবনের শুরু হয়েছিল। ঠিক তখনই বিয়ে নামক সংস্কারের পদবী ঝুলে গেছে গলায়। বৈবাহিক জীবনের প্রারম্ভেই ভাটা পড়ে তার সব কিছুর। প্রেমার কন্ঠের সুর পালালো। বিকৃত বাস্তবের নিদারুণ কষাঘাতে প্রথমে সে নেশায় আসক্তি হয়। এবং পরবর্তীতে চারিত্রিক অবক্ষয়ে কলুষিত হলো। নিষিদ্ধ ভোরের ক্ষণস্হায়ী শিশির বিন্দুর মতই যবনিকা হয়ে গেল তার সরল জীবনের ।
প্রেমা অর্ধশিক্ষিতা তরুণী সন্তানের মা।
জামিলের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা আর রুঢ় অন্যায়ের কাছে তার গর্ভস্হ সন্তানদের স্বার্থে প্রেমা নতি স্বীকার করে একপ্রকার সবকিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। বছর সাত নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে মোটামুটি টিকেছিল তাদের সংসার। কিন্তু নেশা ও গান গাওয়াটা ছাড়তে পারে নাই। গান ওর আজন্মের সাথী, ভালোবাসা ও জীবন। এক সময় শখের বশে গান শিখেছে। পরে তা রুটিন মাফিক হয়ে গেছিলো ।
অবশ্য প্রেমা গান যে গাইতো তার জন্য সব কিছু না।গান একটা উপলক্ষ ছিল। বিভিন্ন টালবাহানা আর ওজর আপত্তি তুলে কারণ অকারণে মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক কষ্ট দেয় জামিল। সংসারে কলহ ঘটায়।নিজের সন্তানদের প্রতিও তার অনীহা অবহেলা। সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য নেই। পুরুষ মানুষ এমনই অদ্ভুত হয়।
প্রেমা স্বাধীনচেতা, একরোখা ও জেদী মেয়ে। নতিস্বীকারে অনভ্যস্ত। ইতর জামিলের নাগপাশে বন্দী হয়েও হৃদয়ে সুরের অস্বিত্ব ধারন করে নিরবে শুধু কামনা করতো তার জীবন অবসানের।
প্রেমার কন্ঠস্বর সত্যি সত্যিই অতি সুমিষ্ঠ, সুরেলা। কোকিলকন্ঠী বলা যায়। ভালো কন্ঠশিল্পী হিসেবে তার বেশ নাম ডাক। কথাটা কেউ বিশ্বাস করুক ছাই না করুক, বাঁধন নামে তরুণ এক কবি প্রেমার গানের মুগ্ধ সমঝদার। সে প্রেমার চেয়ে অধিক বয়োকনিষ্ঠ। ভক্ত বাঁধনের অনুভূতি উৎসারনের একটি উন্মাদনা ছিল প্রেমার সম্পর্কে। তার বদ্ধমূল ধারণা, ভবিষ্যতে প্রেমা উঁচুদরের শিল্পী হিসেবে সম্মানের সহিত দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। মনেপ্রাণে সে এতটাই বিশ্বাস করতো আর অনুপ্রাণিত হতো যে, নিজের মনের অপরিমেয় আনন্দে বাঁধন তার অনেক কবিতা প্রেমাকে কল্পনা করে নিজস্ব ব্যঞ্জনায় অপরূপ ফুটিয়ে তুলেছে ।
ইতোমধ্যে সাহিত্যিক হিসেবে বাঁধনের দেশজুড়ে অতীব সুকীর্তি। নামকরা কাগজ পত্রিকায় তার লেখা সব ছাপা হয়। সম্প্রতি একখানা কবিতা গ্রন্থ বেরিয়েছে।
বাঁধনের অস্বচ্ছল পরিবার। পিতা মাতা ভাইবোন সকলেই মফস্বলে থাকে। বাঁধন শহরে এসেছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। তার স্কলারশিপের মাত্র কটা টাকা সম্বল। বাকিটা টিউশন করে জোগায়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি থেকে এম, এস করছে। বিষয় বায়োকেমিষ্ট্রি। পিয়াস তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পিয়াসের পীড়াপীড়িতে হোস্টেল ছেড়ে একসাথে তারা ভাড়া করা মেসবাড়িতে থাকে। লাভটা বাঁধনের। মাস শেষে সীটের ভাড়া গুনতে হয় না। ধরাবাঁধা সময় নির্ধারণ নেই। স্বাধীনতা আছে।
বাঁধনের কেরানী পিতার আর্থিক সঙ্গতি নেই । বরাবর তার পড়ার খরচ বহনে অপারগ। এম, এস, সি শেষ হওয়া মাত্র পিতা তাকে পইপই করে বলেছেন কোনো বিদেশী ব্যাংক অথবা পোস্ট অফিসের জুনিয়র অফিসারের চাকরি জোটাতে। পরিবারের আর্থিক সঙ্কট কিছুটা দূরীভূত হবে।
ছাত্র হিসেবে বাঁধন খুবই ভালো। আগের রেজাল্টের বিবেচনা করলে আশা করা যায় সামনে অপেক্ষা করছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সে তার পিতার কথায় কর্ণপাত না করে এম, এস শুরু করেছিল। এই বছরেই থিসিস শেষ হবে।
সে অতি কর্মঠ ও উদ্যমী যুবক। গত ছয় মাস যাবৎ এক জুতার দোকানে সেলস্ ম্যান হিসেবে ঢুকেছিল। দোকানটি অভিজাত এলাকায়। সম্প্রতি সেখানকার ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়ে টিউশন ছেড়েছে। বেতন খারাপ না। দোকানের মালিক পিয়াসের পিতা।
পিয়াসের পিতা অতিশয় ধনী ব্যবসায়ী। তার অনেক রকম ব্যবসা । প্রাথমিক অবস্থায় চামড়ার ট্যানারী করে আজকের এই অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। এই শহরে তার বেশ কয়েকটি বাড়ি ও ব্যবহারের গাড়ি আছে। পিয়াস কি কারণে মেসবাড়িতে থাকে, এসব খোঁঢাখুঁচি করার আবশ্যকতা মনে করে না বাঁধন।
সে জ্ঞাত, ধনীদের মাথায় কত রকমের খেয়াল থাকে।
চলবে……..