বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) সংক্রমণের প্রভাবে দেশে তৈরি পোশাক শিল্প সুরক্ষায় শুরুতেই নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। বিশেষত, পোশাক খাতে শ্রমিকরা যাতে চাকরি না হারায় সে জন্য বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা দেওয়া হয়। বৈশ্বিক দাতা প্রতিষ্ঠানসহ ক্রেতারাও পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেয়, পোশাককর্মীদের মজুরি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রকৃত চিত্রে এসবের প্রতিফলন খুবই কম। রক্ষা হচ্ছে না শ্রমিকদের চাকরি। চলতি বছরের পরবর্তী ছয় মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারাবে।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পোশাক কারখানায় লেঅফ ও শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। এ নিয়ে শ্রম অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় মে মাস পর্যন্ত শ্রমিক ছাঁটাই ও লেঅফ না করার অঙ্গীকার করেছিল মালিকপক্ষ। তবে ঈদুল ফিতরের পর থেকেই একের পর এক গার্মেন্টে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবর আসতে থাকে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ও দাতা প্রতিষ্ঠানের নানা সহযোগিতা নিয়েও কারখানার মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাই করার সিদ্ধান্তে অটল। ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে তাদের জন্য। সরকারের প্রণোদনার অর্থ থেকে এখন শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরেও ঋণ, এলসি সেটলমেন্ট, পরিষেবার বিল পরিশোধ ছাড়াও ভ্যাট ট্যাক্সসহ বেশ কিছু খাতে তাদের ছাড় কিংবা সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাসে গার্মেন্টের প্রায় ২৫ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হবে। কারণ কারখানায় কাজ না থাকলে মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। বর্তমানে পোশাক খাতে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। সে হিসাবে ছাঁটাইয়ের কবলে পড়তে পারে আট থেকে ১০ লাখ শ্রমিক।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যে অন্তত ৭০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পোশাক খাতে প্রায় সাত-আট লাখ শ্রমিকের চাকরি যাবে। প্রতিদিনই শ্রমিক ছাঁটাই এবং কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে ইতিমধ্যে সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায় করে নিয়েছে মালিকপক্ষ। আর শ্রমিক কমাতে মালিকরা নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। আরো সুবিধা হাতিয়ে নিতেই এখন তাঁরা শ্রমিকদের রিজিকে হাত দিয়েছেন। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা উদ্বেগজনক।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার খবর তাদের কাছে রয়েছে। অবশ্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। ছাঁটাইয়ের এই ধারা আগামী কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শিল্প পুলিশ সূত্র গতকাল রবিবার জানায়, ইতিমধ্যে এক হাজার ৬৬২ জন পোশাক শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের শ্যাটার্ন টেক্সটাইল লিমিটেড ১৭০, মাস্কো গ্রুপের শান্তা এক্সপ্রেশন ১৫, নীট বাজার প্রাইভেট লিমিটেড ৬৯, মজুমদার গার্মেন্টস লিমিটেড এক শ, তানাজ ফ্যাশন লিমিটেড এক হাজার ২৯৩ ও পার্ক ভিউ ড্রেসেস লিমিটেড ১৫ জন শ্রমিক ছাঁটাই করেছে।
বন্ধ হয়ে গেছে চারটি কারখানা। গাজীপুরের প্রচেষ্টা নিট টেক্স ২৫০ শ্রমিকের মার্চ মাসের ৫০ শতাংশ এবং এপ্রিল ও মে মাসের পুরো বেতন বাকি রেখে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে। ইউনিটেক্স এটার্য়েস লিমিটেড মোট ৩০০ শ্রমিকের এপ্রিল ও মে মাসের বেতন এবং ঈদ বোনাস বাকি রেখে ফ্যাক্টরি বন্ধ করেছে। আর ফেম সোয়েটার্স লিমিটেড ও শাওন ফ্যাশন লিমিটেড কারখানা করে দিয়েছে কার্যাদেশ না থাকার কারণ দেখিয়ে। শিল্প পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাজ নেই এমন এক হাজারের বেশি পোশাক কারখানা আগামী ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে মোট পোশাক শ্রমিকদের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ছাঁটাইয়ের শিকার হবে।
এমবি নিট ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ হাতেম জানান, তাঁর কারখানায় ইতিমধ্যে ১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। আরো ৩০ শতাংশ ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া আরো একাধিক পোশাকশিল্প মালিকের সঙ্গে আলাপ করে তাদের কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার আভাস পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং আইএলওর সাবেক কর্মকর্তা ড. উত্তম কুমার দাস বলেন, কর্মী ছাঁটাই মালিকের অধিকার (সংখ্যাতিরিক্ত)। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করা বেআইনি। করোনা মহামারির এই সময়ে সরকারের প্রণোদনা ও দাতা সংস্থার অনুদান নিয়েও শ্রমিক ছাঁটাই করাটা আইনের পরিপূর্ণ লঙ্ঘন।
ছাঁটাই বন্ধের নির্দেশ ডাইফির : বিজিএমইএকে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধের নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। গতকাল দেওয়া এই চিঠিতে আরো বলা হয়, গত ২৫ এপ্রিল ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) এক নম্বর সিদ্ধান্ত অনুসারে করোনা সংকটের এই সময়ে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ এবং কারখানা লে অফ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর পরও গত ঈদুল ফিতরের পর কারখানার মালিকরা ১৭ হাজার ৫৭৯ জন শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন।