1. successrony@gmail.com : Mehedi Hasan Rony :
  2. arif_rashid@live.com : Arif Rashid : Arif Rashid
  3. meherunnesa3285@gmail.com : Meherun Nesa : Meherun Nesa
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৪ অপরাহ্ন

কুবলয়- (শেষ খন্ড)

সিফাত হালিম, ভিয়েনা।
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০
  • ৮১৪ বার

আইজউদ্দীনের পরিবারটি বড়ো বিচিত্র। সবার আচরণে অস্হিরতা। ছেলেমেয়ে প্রত্যেকের চরিত্রের নীচে গভীর অন্ধকার। বিশেষ করে আইজউদ্দীনের সুপুত্রী কন্যাগুলো। তাদের কুটনা স্বভাব, কীর্তিকলাপে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন এবং পাড়ার এমাথা থেকে ঐমাথার সাধারণ লোকজন। কখন যে কাকে আক্রমণ করে বসে । মানুষের গীবত গাওয়া, অপমান অপদস্থ করে তাদের তৃপ্তি । বাতাসের গলায় দড়ি দিয়ে খামাকা একারাই কাউকে না কাউকে গালমন্দ করবে । মুখ খিস্তি, ঝগড়া নাড়াই করে। ওদের মুখের ধার যেন ফোরফোরটি। কন্ঠে মাশা-আল্লাহ মাইকের জোর।
প্রত্যেকই ডরে ডরে থাকে। দূর্ণাম ও কলহের ভয়ে তাদেরকে ঘাটায় না কেউই। তাদের লোকভয়, সামাজিক শিষ্ঠাচার নেই। কোনো কাজে বাঁধা দিতে গেলেও তাদের কাছে অপমানিত হতে হয়। অনেক সময় প্রহৃতও হতে হয়।

বিবাহের পরেও সবক’টি কন্যা তাদের স্বামী সন্তানাদি নিয়ে গলাগলি বসতবাটি তুলে আছে বাপের ভিটেয়। সংসার ধর্ম, ছেলেমেয়ের ধার ধারেনা। দুষ্টু বুদ্ধি সাজাতে সারারাত বোধহয় ঘুমোয় না। মেজ মেয়েটি বাদে বাকি তিনটি দূর্ভিক্ষের রানী। শরীর শুকিয়ে শালিকের বাচ্চার মতন হাঁড় বের হওয়া । মনেহয়, দু’বেলা পেট পুরে খাওয়া জোটেনি কোনদিন ।
ভোর হলে কন্যারা যার যার ছেলেমেয়েকে আইজউদ্দীনের বাড়িতে ঠেলে পাঠিয়ে নিজেরা পাড়ায় বেরিয়ে পড়ে । সর্বক্ষণ হাঁসের মতো চইচই করে ঘরে ঘরে ঘুরে লোকের তত্ত্ব তল্লাশে। এরপরে নিজেদের মতো সাজিয়ে বানিয়ে এক প্রতিবেশীর ঘরের সংবাদ আরেক ঘরে সাপ্লাই দেয় অনর্থক। এ ওর মাঝে মন কষাকষি,ঝগড়া ফ্যাসাদ বাঁধানো তাদের কাজ। যেন তারাই সব বিবিসির সংবাদদাতা।
এটি একদিনের ঘটনা না। প্রতিদিনই এ গৃহে এরকম কিছু না কিছু হয়ই।
নিজেদের ক্ষেত্রেও তারা একই রকম। নারী পুরুষের জিভের কোনো কলসা নেই। যে কোনরকম কুকথা তারা অনর্গল বলে যায়। যখন তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে মা ভাই বোন মিলে, তখন সেখানে উল্টি ওঠা লজ্জার উলঙ্গ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাদের হল্লা কিচিরমিচিরে আশেপাশের বাড়ির শিশুরা হঠাৎ ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে। পাড়ার বৌ ঝিরা জিভ কেটে দরজা আটকে রাখে। নয়তো কান চেপে ধরে নাউযুবিল্লাহ* বা আসতাগফিরুল্লাহ* পড়ে। পুরুষরা বাইরে বেরুতে ভয় পায় লজ্জায়।

আইজউদ্দীনের বিশাল সহায় সম্পত্তি। তার সম্পত্তি ভাগাভাগির উদ্যোগটিতে হাঙ্গামা হয়েছিল অনেক বেশি। মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ালো। সেই সময় বেশিরভাগ ঝগড়া হতো আইজউদ্দীনের মৃত্যুর পরে।
এদেশে আইনী ব্যবস্থার মধ্যেও অনেক বৈষম্য আছে। পুত্র ও কন্যার মাঝেরকার ভাগাভাগিতে পুত্ররা কতকগুলি সুবিধা বেশি পায়। স্বয়ং জামিলা বেগম স্বীয় কন্যাদের বিষয়ে তাচ্ছিল্য গড়িমসি আছে । পুত্র ও কন্যা তার কাছে দুই রকম । সে কন্যাদের সম্পত্তির ভাগ দিতে নারাজ ।
যদিও আইজউদ্দীন মৃত্যুর কিছুকাল আগে লেখাপড়া করে সম্পত্তির সুষ্ঠু বন্টননামার বন্দোবস্ত চেয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। শুভ সংকল্পে নানান ঝামেলা জটিলতায় পিছিয়ে যায়। নিয়তি কখন যে কার সাথে কীরকম আচরণ করবে তা জানার সাধ্যি নেই কারোর । ইতোমধ্যে ছোট পুত্র মাখনের অকাল মৃত্যু দেখে সে বিষণ্ণ দ্বিগবিদিক জ্ঞান শূন্য থাকতো। তবে আইজউদ্দীন তার মৃত্যু শয্যায় বিনীতভাবে পাড়ার ঘনিষ্ঠ গন্যমান্যকে ডেকে বলে যায়, তার সম্পত্তিতে কন্যাদের অংশ যেন শরিয়ত মোতাবেক নিশ্চিত করা থাকে । এই মর্মে সে তার স্ত্রী ও পুত্র মদনকেও নির্দেশ দিয়ে যায়। নইলে তার আত্মা কিছুতেই শান্তি পাবে না।

অথচ আইজউদ্দীনের মৃত্যুর পরে, এ বাড়ির সবরকম ব্যবস্থাপনা, চাবিকাঠি মদনের হাতে। কন্যারা পিতার সম্পত্তিতে যখনই উঠে আসে, তাদের নিজের ভাগটি বুঝে নিতে চায়। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা সংক্রান্ত কথা ওঠায় । তখনই মদন জগন মিলে তাদের উপরে মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করে।
জামিলা বেগমের কাছে কোনো প্রতিবিধান নাই। বরং মেয়েরা যতই বিদ্রোহী হওয়ার চেষ্টা করুক সকলে মিলে একযোগে নানান প্যাচ কষে। তাদেরকে আরও উল্টোপাল্টা কথা বলে তাড়ায়। যা তা ভাষা প্রয়োগ করে। গা গতরে হাত তুলে লাঞ্চিত করে।
তখন তাদের কারোর মাথায় হুঁশ থাকেনা ।
আইজউদ্দীনের বিধবা বুড়ি স্ত্রী জামিলা বেগমের মাথার একগলা ঘোমটা, উর্ধাঙ্গের বস্ত্র উধাও। বাঁদরের মতো মুখ ভেংচি, লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে সে এবং তার পুত্র কন্যারা পরস্পরের নামে বলাবলিতে নিজেদের গোপনীয় এমন সব প্রকাশ করে ফেলে সেখানে । যে সব কুৎসিত বাক্যের স্রোত বইয়ে দেয় যে, পথচলতি লোকেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে শোনে। তাদের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে।

আইজউদ্দীনের কন্যাদের দুঃসাহস ছিল যথেষ্ট।
তাদের বিরোধ এমনই চরমে উঠেছিল যে, একপর্যায়ে ফৌজদারি মামলা ঠুকে দিলে এই বিস্মমবাদ কিছুটা শান্ত হয়। বসতবাটি ও ভূ সম্পত্তির উপরে তাদের অধীকার স্বীকার এবং ভাগ বাটোয়ারা করতে একপ্রকার বাধ্য করা হয় জননী জামিলা বেগম ও তদ্বীয় পুত্রগণকে ।

পূর্বেই বলা হয়েছে, আইজউদ্দীনের কৃপণতার কথা। তার অনেকগুলো দোষের মধ্যে প্রধান দোষটি ছিল কৃপণতা। অর্থ থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া খরচের প্রতি বেজায় অনীহা। তার জামাই ভাগ্য মন্দ। জ্যেষ্ঠা কন্যার বর নিজের আপন ভাগিনা। একেবারেই কপর্দকশূণ্য । তাকে ঘর দুয়ার, চাকরি দিয়ে ঘর জামাই রাখা হয়েছে। অন্যদিকে পড়শিরা, আত্মীয় স্বজনরা তার প্রতি হিংসুক। এইসব মানুষেরা তার ঐশ্বর্যে কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারে না। জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহ বিষয়ে আড়ালে তার অধঃপতনের কথা তুলে মনোকষ্ট দেয়।

জামিল আইজউদ্দীনের দেশের ছেলে । মধ্য বয়স, বত্রিশ প্রায় । কিন্তু লোভনীয় চাকরি করে। এই পাত্রটি আইজউদ্দীনের নিজের আদলে গড়ে উঠছে। সে জামিলের বিষয়ে কোনপ্রকার খোঁজ খবরের ধার ধারলো না। ইতোমধ্যে জামিল প্রভূত ঐশ্বর্যশালী হয়েছে। টিনের ছাউনির নতুন পাকা ঘর, পুকুর কাটিয়েছে গ্রামে । যৌতুকের চাহিদা নেই। যাকে বলে ত্রিমুখী মিলন। এরকম পাত্র আইজউদ্দীনের কাছে আসমানের চাঁদ। সে এতটাই আনন্দে রবরবা।

আইজউদ্দীনের স্কুল পালানো দ্বিতীয়া কন্যা প্রেমা। লেখাপড়া খুব শক্ত জিনিস তার মাথায় ঢুকে না কিছুতেই । গোবর পুরা মাথা। প্রতিবছর ডাব্বা খাচ্ছে । আইজউদ্দীনের অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় ব্যতিক্রম প্রেমার সবকিছুই, স্বাস্থ্য ভালো । খাঁচার খোলা পাখি। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। মফস্বলের মেয়ে হলেও ছেলেদের মতো সাইকেল, মোটর চালানো শিখেছে। প্যান্ট শার্ট পরে ছেলে বন্ধুদের দলে ভিড়ে মিশে মাঠে ঘাটে টো টো ঘুরে। বাঁশের বাঁশি বাজায়, সুন্দর গান গায়। লুকিয়ে ছাপিয়ে সিগারেট বিড়ি খায়। গাছে গাছে চড়ে আর ডালে ডালে দোল খায়।
সবে যৌবনে পদার্পণ করেছিল প্রেমা। সতেরো আঠারো বছর বয়সের তরুণী যুবতী হবে। এখনই বধূ হবার কথা ভাবে না। দারুণ অর্থ পিশাচ পিতা তার স্কুল ছাড়িয়ে দিয়ে রেখেছে ঘরে । ঘাড়ের উপর বোঝা। পার করতে পারলে বাঁচে। জামিলকে পেয়ে তক্ষুনি আইজউদ্দীন তার এই বাছুর কন্যার সঙ্গে ষাঁড়ের সম্বন্ধ ঠিক করে ফেললো।
সুপরামর্শের জন্য আইজউদ্দীন কারো মত নিতে রাজি না। তার কথা মাত্র কাজ।
আইজউদ্দীন বজ্রগম্ভীর কন্ঠে বাড়ির সবাইকে ডেকে বললো, “ঐ পাত্রকে কথা দিয়েছে। ঐখানে বিয়ে হবে।” লোকশ্রুতি এই , জামিল টোপ হিসাবে বড়ো অঙ্কের একটি অর্থ আইজউদ্দীনকে ধারের নামে দিয়ে সুকৌশলে আইজউদ্দীনের মনে নিজের স্হান করে নিয়েছে। আইজউদ্দীন বহু ব্যাপারে তার উপরে নির্ভর করে।
কারো কোনো আপত্তি নেই প্রেমার বিবাহে।
তারপর শুভক্ষণ দেখে শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়ে যায়।

কে না চায় স্বাধীনতা? কে না ভালোবাসে স্বাধীন থাকতে?
প্রেমা স্বাধীন থেকেছে। তার আজন্ম স্বপ্ন স্বাধীনতা ও সুরের সাধনা । সে মুক্ত থাকবে এবং গান গেয়ে বেড়াবে ।
কিন্তু মানুষ যা চায় তা কি পায় কখনো? পরিপূর্ণ কেউই পায় না।
জামিলের কাছে প্রেমাও পেলো না। বিবাহের রাত্রেই প্রেমার ইচ্ছা হয়েছিল, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু বাপ ভাইয়ের সম্মান রক্ষার্থে বাড়ির বাইরে এক পা দিতে সাহস করেনি ।
প্রাথমিক পর্যায়ে জামিলই প্রেমাকে অন্ধকার পথ চেনালো। স্বাধীনতা দেবার নামে টেনে নিল ভয়ঙ্কর সর্বনাশা পথে। সংক্ষিপ্ত পোশাক পরালো। নিয়মিত নিয়ে যায় বারে, ক্লাব পার্টিতে। বন্ধুদের আড্ডাখানায়। সেখানে বারো স্বভাবের লোকের আনাগোনা। দেশী বিদেশী সব চলে। দামী মদ, সিগারেট তাড়ি গাঁজা ভাঙ খায় তারা । একসময় বন্ধুদের সাথে বসে পাল্লা দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে বিড়ি সিগারেট খেয়েছে প্রেমা। কিছু পারদর্শী ছিল। এখন তো আরো সুযোগ। প্রকাশ্যে মুক্তমনে সব খাচ্ছে । এমনকি বাড়িতে এনে দেদারসে খেয়ে প্রেমা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠলো সেসবে।

প্রেমার অত্যধিক গানের দিকে ঝোঁক রয়েছে ।
জামিল প্রেমার কাছে নিজেকে আরও উদার মহৎ সাজালো। প্রেমাকে ভর্তি করিয়ে দিল গানের স্কুলে। এসবের পিছনে জামিলের বড় একটি দূরঃঅভিসন্ধি রয়েছে, ঘূর্ণাক্ষরেও যা কেউই বুঝেনা।
জামিল বিকৃত মস্তিষ্ক মানসিকতার। অস্বাভাবিক প্রকৃতির অভিজ্ঞ। ট্যাকে কাঁচা টাকার গরম। অনেক দেহে যথেচ্ছ কামলিপ্সা পূরণে গমনাগমন করে থাকে। প্রেমা তার বিবাহিতা স্ত্রী। অথচ প্রেমার সঙ্গেও জামিল শারীরিক মিলনে তদ্রুপ আচরণ করে বা করতে চায়।

শরীরের সঙ্গে মনের আঁতাত। শরীরের সঙ্গে মনের পূর্ণ সমর্থন ও বুঝাবুঝি না থাকলে কারো শরীরে যাওয়ারই মানে নেই। এটা মানতে চায় না জামিল। সে বোঝে যা পাবার তা জোরাজুরি ও বলপ্রয়োগের উপর নির্ভরশীল করে নিজেকেই পেতে হবে। এবং সুখ একার।
এসবে বিরক্তি ঘেন্না বোধহয় প্রেমার । জামিলের কাছে সে সর্বক্ষণ ভয় বিবর্ণ, মুখ এটে সাড়াশব্দহীন । নিষ্প্রাণ জড়বস্তুর ন্যায় নিষ্ক্রিয় থাকে । জামিল এসেছে শুনেই তার বুক থরথর কাঁপে। আর বাসর ঘরে প্রথম রাতের স্মৃতি মনে পড়লেই সে ঘনঘন মূর্ছা যায় । সজ্ঞানে জামিলের চরম লিপ্সা পূরণে সে অক্ষম অপারগ। শরীর খারাপের দোহাই দিয়েও নারী খেঁকোর খপ্পর থেকে পরিত্রাণ নাই ।
জামিল সব দেখে বুঝে। সে এক অদ্ভুত হাসে। সেই হাসির মধ্যে গভীর মতলব ছিল।
জামিল অন্য পন্হা অবলম্বন করে প্রেমার মধ্যে সাড়া আনতে চাইলো। বিশেষ করে নিষ্ক্রিয় প্রেমাকে শয্যায় সক্রিয় করতে চায়। শয়নের পূর্বে বন্ধ ঘরে নীলছবি ছেড়ে দিয়ে প্রেমাকে নেশা করাতে লাগলো। নেশার মাত্রা চড়লে আদিম মানুষের মতো জামিল বিবস্ত্র উলঙ্গ প্রেমার দেহে যথেচ্ছ যৌনাচারে লিপ্ত হয়।
জামিল অত্যন্ত পশুবৃত্তি স্বভাবের।
এমন অস্বাভাবিক আচরণে প্রেমার সমস্ত শরীরে সঞ্চারিত হয় ঘৃণা । প্রতিবাদে ভোগের বাঁধ সাধে প্রেমা। জামিল বেদম প্রহার করে তাকে । প্রায় মুমূর্ষের মতন হয়ে যায় প্রেমা । তখন মৃতপ্রায় ক্ষতবিক্ষত প্রেমাকে বেঘোরে আনতে বল প্রয়োগ চলে । এবং পূণরায় মাত্রাছাড়া মাদক সেবন করিয়ে আসক্তিতে টেনে হিচড়ে সেই কাজে বাধ্য করে । নারী শরীরকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করার পর জামিল পরিতৃপ্ত। দেহে ও মনে স্বস্তি পেত যেন।
জামিল বাড়িতে আসলে ঐসব ছাইপাস খেয়ে দিনরাত্রি নেশায় বুঁদ থাকে প্রেমা। কোথায় ছেলেমেয়ে, সংসার, আত্মীয়, কোথায় কী রয়েছে তার সেসব বোধে আসে না। এইভাবে অভ্যেস গড়ে ওঠার ফলে ধীরে ধীরে পুরোদমে আসক্ত হয়ে গেছিল সে। এমন অভ্যাস হয়ে গেল দিনে যেমন তেমন। রাত্রে সে আর টিকতে পারেনা কিছুতেই। তার প্রয়োজন মোক্ষম দাওয়াই। যে কোনো নেশার বস্তু হলেই হয়। হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ, আফিম। একেবারে না মেলাতে পারলে ঘুমের ট্যাবলেট ও সিগারেট।
প্রেমা পুরোপুরি মদাসক্ত হয়ে পড়েছে । তার সবকিছু নিঃশোষিত বিলিন । গুটিসুটি মেরে বসে থাকে জামিলের পায়ের নীচে। তার করুণার আশায়। জামিলের সকল রকম অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়ায় তার নিয়ম। সে বুঝেছে সেই স্বাধীন জীবনে সে আর কোনদিন ফিরে যেতে পারবে না। এভাবেই তার সারাজীবন কাটবে।
জামিল যথাসময়ে মুখোশ খুলে ফেললো। সকলের কাছে ভালোমানুষির অভিনয় শুরু করলো। ভোরের চড়া পাখির মতো ফুড়ুত করে প্রেমার সামনের থেকে সরিয়ে দিল নেশার যোগান। মিথ্যা অভিযোগের জেরে ইনিয়ে বিনিয়ে বন্ধ করে দিল প্রেমার সমস্ত সাংসারিক খরচ।

ক্রমে প্রেমার সঞ্চিত টাকায় টান পড়ে। বিক্রি হওয়া ধরলো প্রেমার বাড়ির গচ্ছিত মূল্যবান সব জিনিস, অলঙ্কার। লেখাপড়া সে জানেনা। গানও ভালোমত শেখা হয়নি। জামিলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল । দুইটি সন্তানের ব্যয়ভার, স্কুলের খরচ। নেশা, অভাব আর হতাশার সংমিশ্রণে তার মাথা গরম। চক্রাকারে ঘুরে । প্রথম প্রথম সে কিছুদিন ঘরের মধ্যে থেকে ছটফট করলো।

প্রেমার কন্ঠস্বর উন্নত। কথা বলবার ভঙ্গি, দৈহিক গঠন ও চালচলন খুবই আকর্ষণীয় ও খোলামেলা । তার আগের সেই শৃঙ্খলা, চরিত্রের তেজস্বীতা নেই।
জামিলের কথা মনে পড়লেই তার ক্রোধ জাগে। সে হয়ে উঠেছে পূর্ণ বিকারগ্রস্হা, দূর্দম উচ্ছৃংখল। সে খেলতে আর খেলাতে লাগলো যুবক ছেলেদের। আগে তোষামোদ করে লোকজন তার সঙ্গে মিশেছে। এখন তাকেই তোষামোদ করে লোক আনতে হয় ঘরে। অল্প টাকায় অনায়াসে নিজেকে বিকোয়। বাদ যায় না কেউই, উঠতি যৌবন প্রাপ্ত কিশোর তরুণ থেকে বয়স্ক লোক।
কথায় বলে, মানুষ অসৎ সঙ্গের দিকে ঝোঁকে বেশি। আর বয়ঃসন্ধিক্ষণ হলে তো কথাই নেই। অল্প বয়সে কিশোর তরুণরা সহজে নষ্ট পথের দিকে ধায়। প্রভাব খাঁটিয়ে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে প্রেমা এদেরকে ব্যবহার করে। এই সুযোগে প্রেমার বাসায় তার মহল্লা ছাড়াও দূর দূরান্তের অনেক লোকের আনাগোনা শুরু হলো। ধনীর বখে যাওয়া দুলাল, নেশাখোর প্রেমে ব্যর্থ অথবা পকেটে দুটো কাঁচা পয়সা আছে যাদের এরাই সব প্রেমার বন্ধু। । অনেক অগা মগাও ঢুকে যায় প্রেমার ঘরে। সিংহভাগ যুবকই প্রেমার চাইতে বয়সে ছোট।

জামিলের সঙ্গে প্রেমার সম্পর্ক ছিল হালকা হালকা। সবই চলছে উপরে । তাদের কাগজের সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। জামিল মাঝে মাঝে যাতায়াত করে । দুই পাঁচদিন অবস্থান নেয়। সেই অবস্থার মাঝখানে প্রেমার জীবনে বাঁধন এসেছে দমকা বাতাসের ন্যায় হঠাৎই। প্রেমার নষ্ট জীবনের কাহিনী তখন মোড় নিল আর একবার।

প্রেমার কাহিনী বাঁধনের অজানা ছিল । প্রেমা তার স্বল্প পরিচিতা। বিস্তারিত পরিসরে এখনও চেনেনা। সে সৎ ধার্মিক এবং সরল সোজা হৃদয়বান যুবক। দরিদ্র বাবার সন্তান। পকেটে টাকা পয়সা নেই। অনেক বাঁধা বিপত্তি ডিঙিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ডিগ্রী আদায় করেছে। মামাখালুর জোর, ধরাধরির কেউ নেই। উপযুক্ত চাকরি বাকরি জোটাতে পারেনি। হয়ে যাবে। নিজের মেধা আর আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে উঠে আসতে চাইছে স্বনির্ভরতায়। বারংবার প্রেমাকে অক্ষমতার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বাঁধন। এমন সম্পর্ক বিস্তার প্রকৃত পক্ষে অসম্ভব।
অথচ বাঁধনকে মনে ধরেছে প্রেমার। একমাত্র বাঁধনকে ভালোবাসে। তার কাছে দেহমন প্রাণ সমর্পণ করে বসে আছে। এর কারণ কী?
এর কারণ অতি সাধারণ । হিসেবী প্রেমা বাঁধনের চাইতে বাঁধনের ভবিষ্যত পটভূমিকে ভালোবেসেছিল বেশী। সে জানে এই ধরনের মেধাবী বোকাসোকা গোছের ছেলেদের হৃদয় বড়ো নরম কোমল হয় । সহজে বশে থাকে। বাজিয়ে ব্যবহার করে নেওয়া যাবে। তেমনি এখন নেই কিন্তু ভবিষ্যতে বাঁধনের একটি সামাজিক ও শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠবে।
চিন্তাটা ফেলনা না। বাঁধনের মেধায় কোনো ঘাটতি ছিল না । উপযুক্ত চাকরি পেলে সে সোনার রাজহাঁস। জগতের যে কোনো ধনীর সমকক্ষ হতে পারে। কোনমতে প্রেমা বাঁধনের মনের উপর মায়ার প্রভাব বিস্তার করে। বাঁধনের নরম মনে স্বাভাবিক প্রেমের জাল বুনে রাখলো।
হতভাগ্য বাঁধন অতোশতো গূঢ় বোঝেনা। প্রেমা তার মনে সংক্রমিত হয়েছে। সে সরল মনে বুঝলো, বাইরের কেউই তো এই ভালোবাসার সম্পর্ক বুঝতে পারবে না। চাইবে না মেনে নিতে। আমরা দুজনেই শুধু এই সম্পর্ক শুরু করেছি। স্বীকার করেছি। স্বীকৃতি দিয়েছি । সমস্ত সামাজিক ঝড়ঝাপটা থেকে প্রেমাকে আড়াল করে এই সম্পর্কের যতটুকু দাম, জীবনভর ততটুকু দিয়ে যাবো প্রেমাকে। এক নির্ভেজাল সহজ সুন্দর ও স্বাভাবিক স্বীকৃত সম্পর্কের নৈকট্যের মধ্যে দিয়ে প্রেমা শুধুমাত্র তার। ভবিষ্যতে তার মালিকানায় আসবে।

চলবে…..
সংগ্রহ: তৃতীয় সংস্করণ থেকে।

এ জাতীয় আরো সংবাদ