গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। দুপুরের টকটকা কড়া সূর্যের প্রচন্ড গরম। বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে ঘর আরও গরম। সেই সঙ্গে বাইরের দমকা ‘লু’ হাওয়া। ভাঁপ ওঠা গুমোট ভ্যাপসা চতুর্দিক।
ঘরের দ্বারের কাছে মেঝেতে আঁচল ছড়িয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে প্রেমা। কোনদিকে তার খেয়াল নেই। ঘামে ভেজা শরীর। খুবই চিন্তিত ভঙ্গি, অশ্রুসজল। বাড়িতে অন্য কোনো লোক নেই। বাচ্চাদের কোলাহল কিছুক্ষণের জন্য শান্ত। তার দুটি ছেলেমেয়ে পাশের ঘরে। পূর্বেই স্কুল থেকে ফিরেছে। খেয়েদেয়ে এই সময় তারা ঘুমায়। বাসার কাজকর্মের ঠিকে ঝি অপেক্ষা করবে না। অনেকক্ষণ আগে ঘর-বারান্দা মুছে তার খাবার নিয়ে ভেগেছে।
এইবার গত কয়েক বছরের তুলনায় গরমটা বেশি পড়ছে যেন। বাইরের রাস্তায় ঠা ঠা পড়া রোদ্দুর। এখন নির্জন, পথে একটি লোকের ও চলাচল নেই। পারতপক্ষে মধ্যাহ্ন বেলা, কেউ ঘর ছেড়ে বেরোয় না গায়ে ফোসকা পড়ার ভয়ে।
প্রেমার বাড়ির পিছনে প্রাচীর বেষ্টিত মস্তবড় উঠোন। সামনের মতো পিছনদিকেও প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার মাঝামাঝি থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে উঠোনে। সিঁড়ি সংলগ্ন বড় কুলগাছ। কাঁচাপাঁকা কুল আর পাতায় ভরা ডাল নুইয়ে থাকে। দমকা বাতাসে থেকে থেকে পাতা, কুল টুপটুপ ঝরে পড়ে ভরে আছে গাছের তলা। ওইপাশেই টিউবওয়েল বসানো। প্রাচীরের গা ঘেঁষে পশ্চিম কোনায় পাতাবিহিন একটা বুড়ো কদবেল গাছ। মৌসুমে কখনও একটা দুটো ফল দেয়। আর বাড়ি ঘিরে চারপাশে ফাঁকা ফাঁকা আম ও নারিকেল গাছের চারা লাগানো হয়েছে সদ্য। এছাড়া এঁটেল মাটির গোবরে লেপা মস্তবড় উঠোনটা একেবারে ফাঁকা, ঝকঝকে।
প্রেমার ঘরের জানালায় মোটা পর্দা ঝোলানো। বাইরে থেকে ভিতরটা চোখে দেখা যাবেনা। ঘরে ঢোকার পিছন দিকের দোর খোলা। সেদিক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হু হু করে। ন্যাড়া কদবেল গাছে বসে আছে দুই তিনটা কাক। তাদের কর্কশ গলার কা-কা রবে কিছুটা চিড় ধরছে প্রেমার চিন্তায়। কাকের ডাকে সে কোনমতে মনঃসংযোগ করতে পারছে না। ইতোমধ্যে উঠোনে নেমে কয়েকবার নির্দয় হাতে ঢিল ছুড়ে তাড়াবার চেষ্টা করলো, পারেনি। ডানা ঝটপটিয়ে একটু উড়ে গিয়ে আবার ছফাৎ ছফাৎ করে লাফিয়ে এসে বসেছে ।
কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষ একান্ত নিরালায় নৈঃশব্দের মধ্যে সম্পূর্ণ একলা থাকা পছন্দ করে। প্রেমারও এখন একা থাকতে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষণ আগে একখানা রেজিস্ট্রি পত্র এসেছে তার নামে।
পত্রখানার প্রেরক প্রেমার বর জামিল। জামিল দয়া পরবশ হয়ে কতদিন পরে যে পত্র লিখেছে। তার পুনঃ এবং তৃতীয় বিবাহের খবর জানিয়েছে প্রেমাকে ।
জামিল আইনের পরোয়া করে না। প্রেমার দিকের কোনো প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি কিংবা উচ্চবাচ্য করার কেউ নেই । এবং প্রেমাকে জামিল যে এতোদিনেও বাদ দেয়নি, এতেই যেন তারা ধন্য ছিল । আশ্চর্য।
আইজউদ্দীনের মতো পোড় খাওয়া ঝানু আইনজ্ঞ লোক জামিলের কাছে ধরা খাওয়া মূক বালক। জামিলের উস্কানি, আস্কারা তাতে আরও জোগায়। সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।
জামিল এর আগেও অবজ্ঞা করেছে আইজউদ্দীনকে । এই প্রকারে প্রেমার অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিবাহ করেছিল । সেবারে বিবাহের পরে লোক মারফত আইজউদ্দীনকে অবগত করেছিল মাত্র । এবার জানালো প্রেমাকে লিখে ।
জামিল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ঘর করেছিল বছর দুয়েক ।
চারিত্রিক দোষ ছাড়াও জামিল অনেক দোষে দুষ্ট। সে তার পরিবারের মধ্যেও অত্যন্ত কুটিল ও নীচ রুচির। বিনা দোষে দ্বিতীয় স্ত্রীকে তালাক দিতে গিয়ে তার আপন কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রেমিকা আখ্যা দেয় এবং উভয়ের মধ্যে ব্যাভিচারের সম্পর্ক বিদ্যমান বলে । এই মর্মে দাবী করে কোর্টের রায় সম্বলিত লিখিত তালাকনামা প্রেরণ করেছে সম্প্রতি।
জামিলের এই দূর্বৃত্তের বৃত্তান্তটি শুনেছে প্রেমা জামিলেরই মুখ থেকে । এখনও তালাক ঠিকমতো কার্যকর হতে পারে নাই। বছর ঘুরলো না। এর মধ্যেই আবার বিবাহ।
প্রেমা হতাশ, বিস্মিত বিহ্বল।
প্রেমার যতখানি সাধ্য, তার বেশি সে আর করবে কী করে । বয়স দৌড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রেমারও খানিকটা পরিবর্তন এসেছিল । কয়েকবার কূটকৌশল করেও পারেনি জামিলকে তার ফূর্তির স্হান থেকে নিবৃত্ত করতে । তার দুটো সন্তানের পিতা ভেবে জামিলের সঙ্গে সর্বদা সমঝোতার চেষ্টায় মানিয়ে আসছে প্রাণপণ। তাকে অনেকবার বুঝিয়েছে, প্রেমা শান্তি চায়।
বিবাহিত জীবনের অধিকাংশ দিনই তাদের ঠোকাঠুকি গোলমাল লেগে রয়েছে। । জামিলের মন জোগাতে অসহনীয় পীড়ন দাঁত চেপে সহ্য করতে হয় তাকে। দুগ্ধপোষ্য শিশু সন্তানদের পাশের ঘরে ঘুমাতে পাঠিয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জামিলের বিকৃত কামনায় দেহ উপস্থাপন করেছে। শরীরের তৃপ্তি মিটলে জামিল ক্ষণেক তুষ্ট। পরক্ষণেই যা পূর্বে ছিল তাই।
তাদের সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে বাসর রাত্রে জামিলের অস্বাভাবিক যৌনাচারের কারণে। সেই সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। কথিত আছে, বাসর ঘরে জামিলের দ্বারা শারীরিক অত্যাচারে প্রেমা রক্তাপ্লুত অবস্থায় বিছানায় অজ্ঞান হয়েছিল। সে ভয় জীবনে কখনো কাটেনি প্রেমার। ঋতুমতী হবার মতন। সেবারও সে ভয় পেয়ে আধমরা। পুরো দুইটা দিন না খেয়ে না দেয়ে, কেঁদেকেটে একাকার। ঘরের দোর আটকে মেঝেয় পড়েছিল।
এরপরের কারণ জামিল।
জামিলের উপস্থিতিতে তার হৃৎকম্প শুরু হয় । ভয় আতঙ্কে নাওয়া খাওয়া ভুলে লুকিয়ে থাকতো ঘরের আনাচে কানাচে। আস্তে আস্তে কিছুটা সয়ে আসছে । এখন শারীরিক অপেক্ষা মানসিকভাবে ভীত সে বেশি। এ মানসিক ব্যাধি শেষ পর্যায়ে এক কঠিন অসুখে রুপ নিল। জামিলকে সামনে দেখলেই প্রেমা ভাবে সে বোধহয় মারা যাবে এক্ষুনি।
শেষ পর্যন্ত সবার কানে গিয়ে গড়ালো প্রেমার রক্তাপ্লুত হবার খবর। প্রেমাকে একপলক দেখেই আসল ব্যাপারটি বুঝেছিল জামিলা বেগম। সে কন্যার দূরবস্হা দেখে বিরলে কান্নাকাটি, হা হুতাশ করলো না। উৎকন্ঠিত হয়ে আইজউদ্দীনকেও বকাঝকা করেনা, অল্প বয়সী কন্যাকে ধরে ধাড়িটার সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্যে।
জামিলা বেগম খবরটি বললো, প্রেমার দূর সম্পর্কের এক ভ্রাত্রিবধুর কানে কানে। মদন তখনও বিবাহ করেনি।
যাইহোক, ভাবী প্রেমার মাথায় জল ঢালতে ঢালতে ফুসফাস করে বোঝালো, “মেয়েমানুষের এসব সয়ে চলতে হয়। প্রথম প্রথম অমন সমস্যা কত হবে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে সব।”
এরপরে ভাবী বুঝিয়ে শুনিয়ে যতবারই প্রেমাকে দিয়ে আসতে গেছে জামিলের কাছে, ততবারই প্রেমা ভয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপে। সহজ হতে পারে না কিছুতেই। চিৎকার কান্নাকাটি করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে বাইরে।
জামিলা বেগম অত্যন্ত উত্তেজিত । রেগে গিয়ে তাড়া দিল কয়েকবার । লজ্জাকুন্ঠিতা প্রেমা মুখ খুলবে না । জোর করতে হচ্ছে। অতিথিরা একথা জানলে সকলের সামনে মাথা হেঁট হয়ে যাবে। তারপর সে প্রেমার ডানা কষে ধরে ঘরের আড়ালে টেনে নিয়ে গেল । চোখমুখ রাঙিয়ে তার বিখ্যাত মুখ আলগা করে দিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “হায় হায় কি বিষ ধরেছিলাম গো পেটে। পুরুষদের শোনাতে ডঙ্কা বাজিয়ে ছাড়লো। ধিঙ্গি বেলাজ মেয়ে, লাজ শরমের বালাই নেই। তোর কারণে এইবার সব বরবাদ, রসাতলে গেল মান ইজ্জত । আজ বাদে কাল মা হবি, মেয়েদের অতো দস্যিপণা, আড়াই দাঁড়াই কিসের? একটু নরম শরম হতে হয় গো বাছা।”
প্রেমা নিথর। সে জামিলা বেগমের মেজাজ জানে। উত্তর দিতে সাহস পায়নি ।
ভারতীয় ঘটি জামিলা বেগম এতো সহজে ডুবতে নারাজ। প্রেমার মতিগতি কার্যকলাপ সুনজরে দেখছিল না। তারপর থেকে অবশ্য তাকে রাখা হয়েছিল চোখে চোখে যেন পালিয়ে না যায় ।
বলাইবাহুল্য, প্রেমার কান্নাকাটির কারণে যতটা না লোকজন শুনেছিল, জামিলা বেগমের বাঁজখাই গলার কারণে তা ঢোল পেটানোর মতো হয়ে গেল।
ছোটখাটো জিনিস প্রাপ্তিতে বা সেখান থেকে সুখ খুঁজে নেবার কোনো প্রবণতা ছিল না প্রেমার মধ্যে। সে অল্পতে তুষ্ট নয়। মেজাজ খুব উগ্র এবং দারিদ্র্যকে গ্রাহ্য করেনি কখনো। আগেই বলেছি, স্বভাবে ডানপিটে এবং উড়নচন্ডি। কেউ কখনো তার উপর খবরদারি করুক বা ইচ্ছেমতো চলাফেরা, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করুক সে চায়নি। পুরুষালি ঢঙের মেয়েছেলে, স্বভাবেও তাই। অনেকেই তাকে গেছো বা দস্যি মেয়ে বলে ডাকে।
পাড়ার ছোট বড়ো ছেলেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। দলবেঁধে মিলে একসঙ্গে রঙ্গরস করে, মাঠে ঘাটে সাতচাঁড়া, ডাংগুলি, মার্বেল, হাডুডু খেলে । ঘরের কাঞ্চিতে বসে পয়সা দিয়ে তাস পিটায় । অবিকল ছেলেদের কায়দায় মারপিট করতে পারে। তাদের মতো চুল রাখা, কাপড় পরা দুড়দাড় করে হাঁটাচলা করা তার স্বভাব। পুকুর নদীতে জাল বা ছিপ ফেলে মাছ ধরে। বেট ধরে তরতর করে খেজুর, নারকেল সুপারিগাছে চড়ে ডাব, সুপারি পেড়ে আনা তার অভ্যাস। একবার তো খেজুর গাছের কাঁটার আঘাতে নাকই ছিড়ে ফেলেছিল। মিছেমিছি আইজউদ্দীন আর মদনের পিটুনির দোহাই দিয়ে ভর দুপুরবেলা পুকুর পাড়ে গিয়ে পালিয়ে থাকতো। সময় ক্ষণ মানেনা। আমগাছের মগডালে উঠে কাঁচা আম পেড়ে ঝিনুকে কাটে। ঝাল লবন মাখিয়ে ক্ষুধা মিটায়। এই কিছুদিন আগেও কেউ দেখে ফেলার ভয়ে সে রমযান মাসের রোযায় পুকুরে নেমে ডুবিয়ে জল খেয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছে। মদনের লুঙ্গি আর হাওয়াই শার্ট পরে গরুর গাড়ি বোঝাই মাঠের কাটা পাক ধান, বিচালি, ঘাস নিয়ে এসেছে একাই। এমনকি সাইকেল চালিয়ে দূরবর্তী বাজার থেকে ক্রয় করে বাড়িতে আনতো থলেভর্তি তাদের নিত্যদিনের বাজার সদাই। মাজায় বিড়ি আর দিয়াশলাই সেরে নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় বসে পুকুর পাড়ে কিংবা বাঁশঝাড়ের আড়ালে। ভয়ডর নেই মোটেও। মনমত বিড়ি ফুঁকে গন্ধ ঠেকাতে মসলা দেওয়া পান চিবিয়ে রাত ঘন হতেই ফিরে এসেছে বাড়িতে। মাঝেমধ্যে তার পিতার সাজানো গড়গড়াও টান দিয়ে স্বাদ আস্বাদন করে।
মেয়েরা যদি মেয়েসুলভ না হয়। ব্যবহারে লাজনম্র শান্ত না থাকে তাহলে তাকে আমাদের সমাজে মেয়ে বলে স্বীকার করতে সকলের আপত্তি। অথচ প্রেমার দস্যিপনা বা এসবের জন্য অতীতে কেউ কখনো বকেনি। তার পিতা, ভাই এমনকি যে জামিলা বেগম সেও কখনো কটু কথা বলেনি। স্বাধীনতা খর্ব করেনি। বরঞ্চ তার ভাইবোনেরা প্রেমার আচরণে কৌতুকপূর্ণ মনে ভাবে। মদনের তো একরকম উৎসাহ ছিল প্রেমাকে কৃত্রিম পুরুষ সাজিয়ে রাখার।
মদন প্রেমাকে বসিয়ে মুখে কালো রঙের মোটন কালিতে মোঁচদাঁড়ি আঁকে। প্যান্ট শার্ট পরিয়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিত। তারপর বলতো, ” বাড়ির সবাইকে দেখিয়ে যা পাড়ায় । চিবুক উঁচিয়ে সকলের সামনে ঘুরে বেড়াবি ।”
মদন প্রায়ই প্রেমাকে মোড়ের দোকানে পাঠায় ক্যাপস্টান, স্টার সিগারেট কেনায়। বাড়িতে জানাজানি হবার ভয়ে পড়ার ঘরের দরজায় প্রেমাকে পাহারায় বসিয়ে তার সামনেই ধুমছে সিগারেট টানে ।
প্রেমা ঔৎসুক চোরা চোখে চেয়ে থাকে সেদিকে। যদি দৈবাৎ বড়োদাদা একটু সদয় হয়। যদি একটান পাওয়া যায়।
মদন অতোটা বে-ঈনসাফি করেনি কখনো । সে গুনেগুনে শেষ সুখটান নিয়ে প্রেমার মুখে পুরে দিয়ে বলতো, “ধর এবার তোর পালা,,,, টেস্ট কর,,, । দে টান দে তো একটু ,,,,,,দেখা যাক সিগারেট মুখে কেমন মানাচ্ছে তোকে।”
প্রেমা চঞ্চল হয়ে ওঠে।
বড়োদার আস্কারা আহলাদে প্রেমা সুখে গদগদ। তার মুখে প্রশান্ত তৃপ্তি।
বারো হাত শাড়ি পরে সেজেগুজে আর তিনবার কবুল বলে ব্যস বদলে গেছে প্রেমার সবকিছু । বদলে গেছে মা বাবা, ভাই বোন। ইচ্ছা মতন চলাফেরা করার স্বাধীনতা নেই। বন্দি করে রাখা হয়েছে একটা ঘরে। এমনকি এই বাড়ির মধ্যেও সে যে আহত হরিণের মতো ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছে। এর জন্য কেউ তো ব্যাঘ্র জামিলকে ভর্ৎসনা করছে না। তাকে বুঝিয়ে নিবৃত্ত থাকতে মুখে একটি কথাও উচ্চারণ করছে না। বরং প্রেমাকে সতর্ক চুপচাপ থাকতে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। সব দোষ প্রেমার। এ কেমন বিচার?
প্রেমার বিবাহ উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি নতুন পুরনো সব আত্মীয় স্বজন। তাদের আনাগোনায় এই বাড়ির সবাই এখন ব্যস্ত। কয়েকটি দিন আনন্দ উৎসবে মেতে থাকলো সকলে। প্রেমা সে উৎসবে যোগ দিতে উৎসাহ পেলো না। মানুষের সংসর্গে ভালো লাগে না। শরীরের এক জ্বালা আর মন ও বুকের শূন্যতা নিয়ে সে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে লাগলো। নিজেকে আড়াল করে চলে। কেউ ঘূর্ণাক্ষরে তার দিকে তাকালে প্রেমার মনে হতো সবাই বুঝি তাকে নিয়ে মেতেছে ঠাট্টা তামাশায়। সে এক কঠিন পরীক্ষা। এতে তার শরীরে শুরু হয় আচানক রাগের প্রদাহ। এ যন্ত্রণা যে কী তীব্র, তা আর অন্য কে বুঝবে। সে মেঝেয় লুটিয়ে খানিক হিসহিস করে ক্রোধে। আর ক্ষোভের দুঃখে কাঁদতে থাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে।
একমনে সেই দুপুর থেকে ভূমি শয্যায় শুয়ে অনবরত রোদন করে অতীত প্রসঙ্গে ভাবছিল প্রেমা। স্বাভাবিক নিয়মে পুরনো দিনের কথা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে প্রেমার স্মৃতিতে। এখন দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল। শরীরে মানুষের স্পর্শ লাগতেই প্রেমা ধড়ফড় করে উঠে বসলো। দারুণ চমকে গিয়ে বলে উঠলো, “কে?”
বাঁধন খুব কাছে বসে মেঝেয় হাত রেখে ঝুঁকে একদৃষ্টে দেখছিল প্রেমার ভেজা মুখখানি। ভরা বর্ষার নদীর মতই পূর্ণ যৌবনা যুবতী । ফেটে পড়ার মতন দুধসাদা গাত্রবর্ণ ও পদ্মলোচন নেত্রের রুপসী সে নয়। থ্যাবড়া থ্যাবড়া নাক চোখ মুখের নকশা, বর্ণ কালো কিন্তু লাবণ্যে ভরা। এই লাবণ্যই তার শ্রীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। ক্বচিৎ দেখা যায়। চোখে লাগার মতো।
বাংলাদেশে সৌন্দর্যের প্রথম লক্ষণ হলো গাত্রবর্ণ কতখানি গৌর। কিন্তু প্রেমার সকল সৌন্দর্য তার কালো মায়াবতী লাবণ্যে। পাহাড়ি মেয়েদের মতো বনে জঙ্গলে অবাধে বেড়ে ওঠা কোনো জংলী ফুল যেন। নিবিড় কাঁটাযুক্ত ঝাঁঝালো বুনো গন্ধের সুরভি মাখা। দেহবল্লরীতে শারদ শিশিরের মতন পড়েছে কয়েক ফোঁটা ঘামের শ্বেতকনা। তার বুকের খাঁজে যৌবনের জ্বলন্ত অগ্নিশিখার খাঁড়াই উপত্যকা। গরমে ভিজে সূতিশাড়ি জড়িয়ে ফুটে রয়েছে গিরিশৃঙ্গের ন্যায় উরুভঙ্গিমা। ঠোঁটে মৃদু আহবানের অগ্নিগিরি। একে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কী করে?
অস্তাচলের মৃদু সূর্যালোকে বাঁধন দেখলো ইন্দিবর ,নীলপদ্ম । স্নিগ্ধ কোমল নীলকমল, একটি কুবলয় ।
চলবে,,,,,,,
সংগ্রহ :—*কুবলয়* তৃতীয় সংস্করণ থেকে