প্রেমার মুখে ভুরভুর কড়া উগ্র একটা গন্ধ । সে চোখ খুলে তাকালো। কান্নাকাটির মধ্যে নেশা করেছে। সমস্ত মুখ চোখ লাল, ফোলা ফোলা।
বাঁধন ব্যস্ত সমস্ত সরে গেল।
বাঁধনকে দেখে প্রেমার চোখমুখ ঝলমল উদ্ভাসিত , আনন্দে আত্মহারা। অকৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে প্রেমা আবার প্রশ্ন করলো, “একি তুমি এমন অসময়ে, কখন এলে? বসেছিলে তো ভালো। তা সরে গেলে কেন? ”
প্রেমাকে অমনভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বাঁধন সত্যি ভয়ের সাথে অবাক হয়েছিল।
বাঁধন তার কথার জবাব না দিয়ে পূণঃ পাশে বসে পড়ে বললো, “ভর সন্ধ্যায় শুয়ে আছো যে, শরীর কি খারাপ?”
তুমি ভিতরে ঢুকলে কিভাবে?” পূণরায় প্রশ্ন প্রেমার।
পিছন দিক দিয়ে, গেট খোলা ছিল। আবিষ্ট হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম বারান্দায়। তোমাকে একটু দেখছিলাম। তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি। কি অদ্ভুত মানুষের মন। আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। নিশ্চুপে এসে তোমার পাশে বসেছিলাম । ”
প্রেমা ঈষৎ চটুল হাস্যে শুধলো, “আহারে ঢং। আমি বুঝি সুন্দরী? ”
কি জানি। আমার তো ওই রুপেই ভজনা। তুমি যতই বলো। ”
প্রেমা তার চাইতে কয়েক বছরের বড়ো, বিবাহিতা। তার দুই সন্তান আছে । এসব একবার ও মনে হয় না বাঁধনের। সে অপলকে প্রেমার দিকে চেয়ে রইলো। কী যে ভালো লাগে কী বলবে। মনেহয় প্রেমার মুখের দিকে যুগযুগ এইভাবে তাকিয়ে থাকতে পারে।
প্রেমা বললো,” তুমি এমন ধারার কথা বলো। ছাড়ো ওসব। তবে তন্দ্রামত এসেছিল, আমি ঘুমাইনি। মনের মধ্যে ধিকিধিকি আগুন নিয়ে কেউ কি ঘুমাতে পারে, না ঘুমায়?” প্রেমার মুখে বেদনার রেখা।
তা নয়। মনেহলো তাই বললাম। কিন্তু তোমার চোখের কোনায় জলের দাগ। কাঁদছিলে এ নিশ্চয়ই ঠিক।” মেয়েদের অকস্মাৎ হাসি বা কান্নার কারণ সে বিশেষ কিছু বোঝেনা। কিন্তু প্রেমার চোখে জল দেখে যে তারও চোখে জল আসে। সে অতিকষ্টে নিজেকে সামলে রাখে।
জামিলের দ্বিতীয় দার পরিগ্রহণের খবর পেয়ে প্রেমা জামিলের জন্য বিরলে অশ্রুপাত করতো। যাবতীয় শাস্তি স্ত্রী লোকদেরই প্রাপ্য। এখন মনে পড়লেই নিজের প্রতি ধিক্কারে প্রেমার গাত্র জ্বলে অপাত্রে জল ঢালার জন্য ।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
মানুষ তার এক জীবনে অনেকবার মরে।”
আমি মরলে তুমি পার পাও? ”
কী আজগুবি কথা। এমন বয়সে তুমি মরবে কেন?”
তুমি তো তাইই চাও। সে কথা থাক। তুমি হঠাৎ কেন এখানে ? আমাকে দেখতে এসেছো? ”
বাঁধন শুধু ঈষৎ সংশয়পূর্ণ নয়নে দু’ একবার তাকালো প্রেমার দিকে। অপমান বোধ করে কী না?
এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ফিরে এসেছি, ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। খরচের টাকাটাও দেওয়া হলো।” বাঁধন প্যান্টের পকেট হাতড়ে তার মাসিক বেতনের পুরোটাই রাখলো প্রেমার পাশে।
প্রেমা নিঃসংকোচে টাকাগুলো দলামুচ করে মুঠোয় তুললো। স্বচ্ছন্দে হাই ছেড়ে আরষ্ঠতা কাটিয়ে বললো,” শুনলাম হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছো। তা কেমন দিলে আজকের ইন্টারভিউ? ”
জানিনা। ”
জানো না মানে?”
পরীক্ষায় সে বরাবরই ভালো করে। অথচ চাকরি হচ্ছে না। তো কী বলবে?
বাঁধন খুব গম্ভীর স্বরে বললো, “খুব নৈরাশ্যব্যঞ্জক কিছুনা। কিন্তু এটুকু তো যথেষ্ট না। তোমায় মিথ্যে বলিনি। ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা ছিলেন তারাই ভালো বলতে পারবেন । কাঁদছিলে কেন সেটা আগে বলো। শুনে চলে যাই। আর একী,,,,,,? ”
প্রেমা স্বচ্ছন্দে বললো, “দেখছো চিঠি।”
কার?”
প্রেমা পত্রখানা বাঁধনকে ঠেলে দিয়ে বললো,” জামিলের। সে পূণরায় বিবাহ করেছে।”প্রেমার কন্ঠে খানিকটা আবেগ ফুটে উঠেছিল।
বাঁধন অপ্রস্তুত। সে বলে বসলো ,”তোমার কষ্ট হচ্ছে? ”
প্রেমার চোখমুখে একটা তেজী ভাব। সে বললো,” অযৌক্তিক। ঐরকম অনেক কষ্ট জামিল আমাকে দিয়ে সহ্য করায়। জামিল আমার সন্তানদের পিতা। একটু চেষ্টা করলে আমরা দুজন মিলে সুখি হতে পারতাম।”
কটাক্ষ করলো বাঁধন,”জামিল সাহেব বিবাহ করেছেন তার জন্য ভেঙে পড়বার কী আছে। এমন তো না এই প্রথম। এ স্বভাব ওনার বরাবরের। তার জন্যই তোমার কষ্ট হয়, মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। এতো অল্পতে?”
তুমি পাশে আছো জানলে কখনই তাকে কষ্ট বলে মনেহবে না। এখন যেমন ঠিক হয়ে গেছি।”
বাঁধনের বয়স কম, আদর্শবাদী, ন্যায় অন্যায় সম্পর্কে সজাগ । সে আরও অবাক হলো এই ভেবে যে, প্রেমার পিতা এমন একটা কান্ড বারবার ঘটতে দিচ্ছে। একাধারে জামিলকে প্রশ্রয় দেওয়া । এদেশ থেকে বিচার ব্যবস্থা তবে উঠেই গেল। জামিল প্রেমার মনে দুঃখ দিয়েই চলেছে। এর কোনো বিহিত ব্যবস্থা নেই?
চাইলে তুমিও একটা বিবাহ করতে পারো । আমাদের সমাজে এরকম কত হচ্ছে। আইনের দিক থেকে কোনো বাঁধা নেই। কোনো ব্যক্তির সুস্থ্য স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী বর্তমানে সে যদি একাধারে দার পরিগ্রহ করে চলে, তাহলে স্ত্রী পারবে না কেন? ”
বলেছো ভালো। একেকবার যে ইচ্ছা জাগে না, তা না বলা হবে মিথ্যা । সব ছেড়েছুড়ে দিই মনেহয়। কিন্তু সেও যে আরেক পরাধীনতা, আরেক মৃত্যু। আমার সেই মানুষটি কে? খোঁজ জানো? তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারো? ”
কোথায়? ”
বিবাহ হবেটা কার সঙ্গে? সেখানে শুধুমাত্র সে আর আমি। ”
কাতর হাসছে প্রেমা।
বাঁধন আবেগাপ্লুত। প্রেমার হাত টেনে ধরে বললো, “তোমাকে বাঁচতেই হবে। মানুষের একটাই জীবন। তা বড়ো সুন্দর, বড়ো মনোরম। বাচ্চা দুটোর কথা ভেবে মন বেঁধে ঘরে থাকো। ওদেরকে মানুষ করো । একদিন ওরাই তোমার সকল দুঃখ ঘুচাবে।”
অমনি প্রেমা ব্যগ্র হয়ে বাঁধনের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বললো, ” আর তুমি কী করবে? ,,,,, তুমি কী বিয়ে করবে না?”
আমি কী করবো মানে? স্বাবলম্বী বলতে যা বুঝায় তেমন স্হায়ী চাকরি বাকরি হয়নি। এখনও লোকের দয়ার উপর নির্ভর করে চলছি। নিজেরি কোনমতে দুটো ডালভাত জুটে। থাকার নির্দিষ্ট জায়গাটুকু নেই। এই মুহূর্তে বিবাহ করে বৌ নিয়ে তুলবো কোথায়? আমার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ”
বাঁধন মৃদু হাসে। মনোমুগ্ধকর সে হাসি।
প্রেমা চমকে উঠলো না। মুখ তুলে সামলে নিল নিজেকে শুধু।
বেশ। এ জন্মে আমি অক্ষম হলাম। বাঁধনকে বাঁধতে পারলাম না আঁচলের গেরোয়? আমার খেয়ালের বশে বিবাহ করে তুমি পস্তাবে। লোকের দয়া অনুগ্রহ নিয়ে চলবে আর আমার সহ্য করতে হবে? তবে তোমার মতো করে কাউকে পেলে, নিশ্চিত আশ্বাস বিশ্বাস ও ভরসা দেবে। চিরটাকাল বাঁচতে বলবে, এমন কেউ হলে সত্যিই বিবাহের কথা ভাববো। । একটা সত্যি করে বলো দেখি বাঁধন, আমাকে তুমি ভালোবাসনি? তোমার মন কী আমাকে চায় না, একটুও ভালোবাসে না? ”
বাঁধন ধীর স্থির। স্নিগ্ধ প্রশান্তির চোখ তুলে চাইলো। প্রেমাকে একটু দেখলো। মনেমনে বললো , “চাইনা মানে, তোমার সব মুঠোর মধ্যে ধরে রাখতে ইচ্ছা করে আমার একান্ত মালিকানায়। এই আশ্চর্য কুমুদ প্রতিমা, সবুজ শালীন ইন্দিবার সৌন্দর্যের ভাগ অন্য কাউকেই আমার দিতে ইচ্ছা করে না।”
বাঁধনের কাছে ভালোবাসার বিষয়টি খুবই গোপন। অন্তরের উচ্চ মর্যাদার আসনে শাশ্বতকালের জন্য যার স্হায়ীত্ব। প্রেমা সবসময় এ বিষয়ে অপ্রকাশ্য। গুপ্ত কোটরে আবেগ লুকিয়ে রাখে। কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজনায় “ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ে”র মতো ভাব নেয় । বাঁধনকে বাজিয়ে দেখা তার স্বভাব খেলা ।
বাঁধন সে ভাব বুঝে। সে চঞ্চলতা পরিহার করে উৎসাহিত না হয়ে উদাস থাকল। সে বেশ কৌতুক বোধ করছিল।
প্রেমা লাল টুকটুকে চোখে কেমন ঘোরের মধ্যে চেয়েছিল। সে চোখ দেখে বাঁধনের মায়া হতে লাগলো। সে হতচকিত। স্মিত হেসে বললো, “এই পৃথিবীতে অনেক চাওয়া আছে যা শুধুমাত্র অন্তরে ফোটে। বাইরে বিকশিত হবার সুযোগ নেই। আমি তোমার প্রেম ভালোবাসা অন্তরে উপলব্ধি করি। ”
প্রেমার এসব কথাগুলো পছন্দ হলোনা। সে বাঁধনের দিকে সরাসরি দৃষ্টি স্হাপন করে ব্যাথাপূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
প্রেমা বাঁধনকে নিয়ে স্পষ্ট ঘর বাঁধার ইঙ্গিত দিচ্ছে ।
প্রেমা বর্তমানে নেশায় বেঘোরে। সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আছে। তার মাথার ঠিক নাই। বাঁধন বুঝতে পারছে। নেশার ঘোরে সে ঐসব বলছে। ঠান্ডা মস্তিষ্কে নিজের অপারগতা, সহায়হীন পরিস্থিতি আর প্রেমার পারিপার্শ্বিকতা, অত্যাধুনিক জীবন যাপন সব বিত্তান্ত ভেঙে বলে বুঝাবে। প্রেমাকে শান্ত করবে। বাঁধন এখন কিছু না বলাই ঠিক করলো।
প্রেমা বললো, ” আচ্ছা বাদ দাও। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে, আমাকে ছেড়ে দূরের কোথাও যাবেনা? একলা একলা আমার বড়ো ভয় করে। বড়ো ভয় করে।”
বাঁধনের গন্ডে ঠোঁট ছুঁইয়ে আছে প্রেমা।
প্রথমে কেমন একটু হয়ে গেল বাঁধন। নিজেকে গুটাতে পারেনা। চিত্রল হরিণের ন্যায় ছটফট করে। তারপর প্রেমার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর আদরে বললো নিশ্চয়ই। কথা দিলাম। তুমি শান্ত থাকো। ”
ততক্ষণে যেন প্রেমা সজাগ হয়েছে। তার নেশার ভাব অন্তর্হিত।
বাঁধনের থেকে সরে বসলো, “তোমার কাছে ট্রিপল ফাইভ কিংবা বেনসন সিগারেট হবে?”
ভাবাবেগের এই সময়ে এমন অবান্তর উদ্ভট কথা। বাঁধন এই ভয় পাচ্ছিল। তার অসাবধানী মন চমকে সাবধান হলো। সারাদিন রামায়ণ পড়ে সীতা কার মা? সে নিজেই একটু সরে বসে নিল। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললো, “এই সময়ে সিগারেট দিয়ে কী হবে? তুমি জানো আমি ওসব খাইনা। ”
আদুরে গলায় বললো প্রেমা ,” খাওনা খাবে। আমি খাবো, তুমিও খাবে। যত ইচ্ছা তত খাবো । খালি খালি বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না।”
প্রেমা শান্ত হয় না। একটু পরপরেই ঝাঁকিয়ে উঠছে।” তবে আর এখানে ন্যাকা সাজে বসে রয়েছ কেন? বড্ড যন্ত্রণা। ঐ দেরাজের মধ্য থেকে ব্রান্ডির বোতলটা বের করে এনে আমায় দাও।”
বিমূড় হয়ে বসে রয়েছে বাঁধন। সে কখনো কারো ওপর রাগ দেখাতে পারে না। এখনও পারলো না। একটু আহত গলায় শুধু বললো, “তোমাকে জব্দ করতে জামিল এইসব করে। সংসার গড়ে এইযে ভাঙ্গে , এর জন্য একা জামিল দায়ী নয়?”
ঘাড় বাকিয়ে ফুঁসে উঠলো প্রেমা,” আমার ঘর ভাঙলো কোথায়?”
সেইতো একই,,,,।”
থাক থাক আমি আর শুনবো না। আমিই দায়ী তাতে হয়েছে কী। তুমি বাপু যাও তো এখান থেকে। আমাকে জ্বালিও না। উহু,, আমার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে,,,,,, তুমি যাও তো যাও। ”
যাবোই তো।”
হ্যাঁ তাই যাও। সবাই আমার শত্রু। আমি ওদেরকে ড্যাম কেয়ার করি। ওদেরকে শাস্তি দিতে চাই। সবাইকে শাস্তি দেব। তুমিও বাদ যাবে না। ”
শাস্তি দেবে কিভাবে? এইভাবে নিজে অধঃপাতে গিয়ে। এর পরিণাম পরিণতি জানো? ”
কী আমার সবজান্তা রে,,,,,? তুমি জানো? ”
জানি বলেই তো বললাম।”
ঘরের মধ্যে সামান্য অন্ধকার। প্রেমা কথার মধ্যে কোত্থেকে একটা সিগারেট খুঁজে এনে ধরিয়ে টানছে বাঁধনের সামনে ।
তিতো হয়ে গেছে বাঁধনের মনটা। হতবুদ্ধির বাঁধন বললো, ” এতদিন কানাঘুষায় শুনতাম, যা তুমিও বলো। সত্যি বলে বিশ্বাস করিনি। তোমার স্বভাব ভালো নয়। আমি বুঝছি না, তোমার মা বাবা ভাই সব কেমন? চোখের সামনে তোমার যা তা হচ্ছে। যা খুশি তাই করতে দিচ্ছে তোমাকে। আরও যা, সত্য যদি তা হয়,,,,,,,,
বাঁধন আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল,,,,,,,
সেই মুহূর্তে প্রেমা বললো, “যা দেখলে চোখে সবই সত্য। অকপটে তোমাকে বলেছি আগেও। অনেকের মতো তুমিও আমার কাছের, খুব প্রিয় একজন। তুমিই বা কেমন আমাকে যা তা করা থেকে বিরত রাখতে পারছ না। মুখে মুখে অমন কথা উপদেশ কত বলা যায় ।”
বাঁধন দিশেহারা। বিমর্ষ মুখে বললো, “আমার তেমন সামাজিক অধিকার নেই।”
প্রেমা তার নেশার ঘোলাটে চক্ষুদুটি বাঁধনের চোখে সরাসরি স্হাপন করে বললো ,” “করে নিলে পারো। তোমার দাবী আছে। ”
মুচড়ে উঠলো বাঁধনের ভিতরে। আবার নাটকীয়ভাবে দূর্বল হয়ে যায় । সে জড়িয়ে গেছে মায়াভ্রমে। তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে টানছে প্রেমা।
কি সেই দাবী?”
খুব সহজ। লেখাপড়া শিখে যদি তোমার কিছু জ্ঞান হয়। তুমি ব্রিলিয়ান্ট পুরুষ । না বুঝবার কারণ নেই। আমার পরামর্শ একটাই, ভিখ যদি নাই দিলে ধিক্ দেবে কেন? আমি কি পাগল,,,,কিসে কীসব পাগলের মতো বকছি। তোমাকে বকছি,,, কেন?” প্রেমা আচমকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বাঁধন আমল দিল না। সে বললো, “রাত হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমাও গিয়ে। সকালে দেখবে ফ্রেশ, সব ঠিক হয়ে গেছে । ”
নিরাশার ভগ্ন কন্ঠ প্রেমার,” এতই সহজ না? ঘুম না আসলে শুয়ে কী হবে? আমার এসব কোনদিনও ঠিক হবেনা বাঁধন। ”
কব্জায় বাঁধা ঘড়ি দেখে বাঁধন বললো, ” আমি তবে যাই।”
কোথায়? না তুমি যাবেনা। তুমি থাকো। আমি একা একা থেকে কী করবো? একসময় তোমাকে একটা দিন না দেখলে পাগলের মতো শুধু আচরণ করতাম। আমাকে দেখতে এসে তোমাকেও অন্যায় ভাবে অনেকের কথা অপমান সহ্য করতে হয়েছে। এই সমাজের কড়া কঠোর আইন নীতি, আমাদের সামাজিক মেলামেশার বিপক্ষে শুধুমাত্র না সামান্য দেখা সাক্ষাতেরও অন্তরায় ছিল। এখন আমি মুক্ত। সকল পথ খোলা আছে । বাঁধা দেবার কেউই নেই । আমার কাছে আসতে না আসতেই যাই যাই যাই করো। তুমি কিছুতেই যেতে পারবেনা। ” তার আকুতি আবেদন কাঙাল দুঃখীর মতই শোনালো বাঁধনের কর্ণে।
তোমার কথা সবই ঠিক। সেই কতদূর যেতে হবে। টিউশন আছে। আচ্ছা আমি থাকছি আর একটু।”
প্রেমা সিগারেটটা জ্বলন্ত অবস্থায় উঠোনে ছুড়ে দিল। বাঁধনের হাত চেপে ধরে বললো, ” আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই একেবারে । আমার স্বভাব আসলেই ভালো না। তুমি চলে গেলেই আমি ড্রিংক করবো। আরও মদ খাবো। এখন তোমাকে কোথাও যেতে দেবনা। আমি যা দিতে পারি সেটুকু দেওয়ার আনন্দ থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না। আমি বেঁচে থাকতে চাই। জীবনটা সত্যি অনেক সুন্দর ও উপভোগ্য। আমাকে বাঁচাও। চারিদিকের মানুষের এতো স্বার্থপরতার মধ্যে, এতো কষ্ট কান্না এতো অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমাদের প্রত্যেকেরই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। আমি তোমাকে চাই । আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে? আমি তোমার হয়ে সঙ্গে যেতে চাই একেবারেই। তোমার একটা কুঁড়েঘর আর শুধু তুমি হলেই চলে । যেখানে কেউ থাকবে না শুধু তুমি আর আমি থাকবো।”প্রেমা যেন অতিরিক্ত উৎসাহিত হয়ে উঠেছে ।
বাঁধন প্রেমার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। মলিন হেসে স্বান্ত্বনা দিল,” অপেক্ষা করতে হবে। ”
অপেক্ষা করবো কতদিন? মাস,,,,, বছর,,,,? ”
কী করবো বলো সবাই সাহসী হয় না। ” বাঁধন সহজ সরল অপারগতা জানালো।
প্রেমা আহত হয়েছে অনেকখানি। সে প্রতিজ্ঞা করলো, এরপর বাঁধন তাকে চাইলেও সে কিছুতেই রাজি হবে না আর।
শেষপর্যন্ত তুমি আমাকে নিলে না। ফিরিয়ে দিলে। তোমার কাছেও আমার জায়গা হলো না । মনেরেখো আমি শুধুই তোমাকে চেয়েছিলাম,,,, তুমি নিজেকে দিলে না। ”
আহা সে কথা না। তুমি বললে আমি তোমার জন্য কি না পারি। ”
তোমার কিছুই করতে হবেনা । সঙ্গে থেকে সাহস জোগাবে সেটাই পারো না ।”
বাঁধন প্রেমার জন্য দুঃশ্চিন্তাগ্রস্হ। অতি স্নেহে বললো,” আমি তোমার সঙ্গে আছি সবসময়। তবে সবকিছুর পূর্বে তোমার স্বাভাবিকতার প্রয়োজন। তুমি এইসব ছাইপাশ খাওয়া ছেড়ে দাও। এসব সাংঘাতিক সর্বনাশা,,,,। এর থেকে রহিত না করতে পারলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না। এখানে মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে। তোমাকে ভর্তি করে দিয়ে আসি। মাস দুই থাকলে ফিট। পূণরায় স্বাভাবিকে ফিরে আসবে তুমি। তখন আর আমাদের বিষয়টি আটকাবে না ।”
আমি পারব না। বকর বকর না করে যাও তো এখান থেকে। এদিকে আর হবেনা। ”
আমার জবাব হয়নি। কথা না নিয়ে আমি যাবো না। ”
কী জবাব চাও ? আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে। এইপথে একবার প্রবেশ করলে জীবদ্দশায় ফেরত আসা যায় না। ”
বললো কে? এভাবে চলতে থাকলে বরং সমস্যা আরও সামনে। ”
প্রেমা এবার বাঁধনের রোমশ বুকে মাথা রেখে মুখ ঢেকে গুমড়ে গুমড়ে কাদতে লাগলো।
প্রেমার কান্না বাঁধন একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সে করুণ হতবুদ্ধি কিন্তু হাল ছাড়বে না।
বাঁধন বললো,” তুমি নেশা পরিত্যাগ না করলে আমিও আর কক্ষনো এমুখো হবোনা। তোমার কাছে আসব না। শত ডাকলেও না। সস্তা খারাপ কিংবা নোংরা কোনকিছু আমার ভালো লাগে না। তুমি জানো আমি অনেক অন্যরকম।”
পরক্ষণেই প্রেমা বাঁধনের বুকে তার মাথার ভার লাঘব করে দিল। জেদী মেয়ের মতো ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,” তাতে আমার কী এ্যা ? এ জানা কথা, তোমাকে পাবার ভাগ্য আমার নেই। জোর করে আমি তোমার কথা রাখতে পারব না। অযথা নেশা পরিত্যাগ করতে বলে আমাকে বিরক্ত করো না। ”
প্রেমা সহজ, শান্ত হবার পাত্রী না। তার কান্ডজ্ঞান পর্যন্ত চলে গেছে। অঝোর কান্নার মধ্যে বারংবার বলছে, “শুধু তুমি তোমার নিজেকে দিলে না।আমাকে ফিরিয়ে দিলে। ”
বাঁধন হঠাৎ খুব বিমর্ষ বোধ করলো। রুদ্ধ অভিমানে চেয়ে রইলো কতকক্ষণ।
বাইরে একটু একটু হাওয়া আছে। মাঝে মাঝে একটা দুটো শুকনো পাতা হাওয়ায় ঘুরে কাঁপতে কাঁপতে নীচে নেমে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে বাঁধনের ভিতরের অলস ইঞ্জিন ধাক্কাতে ধাক্কাতে চলা শুরু করলো।
এখনও সে প্রেমাকে খারাপ ভাবতে পারে না। কোনো সর্বনাশা পাকে ভর করে প্রেমা ভুল করছে। প্রেমার জন্য সে উদগ্রীব। প্রেমাকে সে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে, জন্ম জন্মের, চিরটাকালের জন্য ভালোবাসে। কতখানি ভালোবাসে তা সে নিজেও নির্ণয় করতে পারে না।
বাঁধনের চোখে ব্যথার মেঘ ছেয়ে এলো। নিরবে প্রেমার হাত ছাড়িয়ে সে উঠলো। ভাবলো, এ কোন ভুলের পাকে অসম সম্পর্কে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। প্রেমাকে সংশোধনে আনা তার কাজ নয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, প্রেমা যদি নিজের থেকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসে তো ভালো। নতুবা প্রেমাকে ভুলতে অতিস্বত্বর তার এই শহর ত্যাগ করতে হবে।
বাঁধন পিছন ফিরে ক্রুদ্ধভাবে চলে গেল। বাইরে তার পদশব্দ হতে লাগলো। তবু প্রেমা তার কাছে নতি স্বীকার করে ফিরে আসবার জন্য ডাকলো না। পিছন পিছন দৌঁড়ে তাকে ডেকে নিল না ঘরের মধ্যে।
নিম্নবিত্ত পরিবারে বাঁধনের জন্ম। সেখানে আচার-বিচার, প্রথা-রেওয়াজ অত্যন্ত কঠিন। পূর্বপুরুষদের চরিত্রে মদ কিংবা বাজে মেয়েমানুষের অস্বিত্ব নেই। পুরুষেরা
পুরুষালি কাজকর্মে বাইরে যাতায়াত করে , ব্যস্ত থাকে। আর মেয়েরা থাকে ঘরের পর্দার মধ্যে। সংসার ধর্ম কর্ম নিয়ে। প্রেমার মতন আপটুডেট, মর্ডান বোতল খাওয়া, সিগারেট টানা ফ্রি স্টাইলে চলাচল করে মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক। বাঁধন এসব পছন্দ করে না। অনেক জটিল খারাপ ভেবে সে নিজেই হতাশাগ্রস্ত । দুঃখে তার নিজেরই বিবাগী হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। তার মুখখানা কালো, চোখের মাঝে জল এসে যাচ্ছে। বাঁধন মুখ নীচু করে দ্রুত হাঁটতে লাগলো মেসবাড়ির দিকে।
চলবে….
তৃতীয় সংস্করণ থেকে…