অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার সপ্তাহপূর্তির দিনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দেশবাসীকে একগাদা আশার বাণী শুনিয়েছেন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং। সেই ভাষণে মিয়ানমারের রাখাইনের বাস্ত্যুচুত লোকজনকে বেসামরিক সরকারের আমলের চুক্তি অনুযায়ীই বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। যদিও তার ঘণ্টাব্যাপি ভাষণে একবারের জন্য রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি মিয়ানমারের এই সেনাপ্রধান।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারে সেনাপ্রধান মিন অংয়ের পুরো ভাষণ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেশটির বেসামরিক সরকার ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন তিনি।
দেশটির গত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উঠলেও সরকার কোনও ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সেনাপ্রধান মিন।
দেশের চলমান সঙ্কটের সমাধানে নতুন সরকারের পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিদেশে আটকা মিয়ানমারের নাগরিকদের দেশে শিগগিরই ফেরানোর কথা বলার পরপরই মিন অং হ্লেইং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সামনে আনেন।
‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি একবারের জন্য উল্লেখ না করলেও মিয়ানমারের এই জান্তা সরকারের প্রধান বলেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী—আমরা বাংলাদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত লোকজনকে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি অব্যাহত রাখবো।
এছাড়া মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে যেসব লোকজন বাস্ত্যুচুত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে মিন অং হ্লেইং বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যেসব লোকজন বাস্ত্যুচুত হয়ে অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন; তাদের পুনর্বাসন কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। দেশের স্বার্থের কোনও ক্ষতি না হলে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ভাষণের শুরুতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই প্রধান বলেন, সেনাবাহিনী একটি সংস্থা; যারা ‘জনগণই পিতামাতা’ উচ্চ মতবাদ ধারণ করে দেশের সেবায় নিয়োজিত। তিনি বলেন, আমি বলতে চাই, সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেমন আলোচনা, আইন এবং বিধি-বিধান অনুযায়ী বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনই রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূলভিত্তি।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার কারণ হিসেবে গত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতির কথা বলেছেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। তিনি বলেন, দেশের জাতীয় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে রাজনৈতিক দলগুলো সেনাবাহিনীর সহায়তা চায়; যে কারণে জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখতে ব্যবস্থা নিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগের পর সেনাবাহিনী তদন্তে নির্বাচনে এক কোটি ৪৮ লাখ ২ হাজার ১১৬টি জাল ভোটের সন্ধান পায়। এই ভোট জালিয়াতি দেশের বিভিন্ন শহর, অঞ্চল এবং রাজ্যগুলোতে পাওয়া গেছে।
সামরিক পোশাকে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে জেনারেল হ্লেইং নতুন নির্বাচন আয়োজন এবং বিজয়ীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের’ মাধ্যমে পরিবর্তিত একটি কমিশন নতুন নির্বাচন আয়োজন করবে।
এই সেনা জেনারেল বলেন, পূর্বের ৪৯ বছরের সামরিক শাসনের তুলনায় তার শাসন হবে ‘আলাদা’। তার শাসনের মাধ্যমে মিয়ানমার ‘সত্যিকারের এবং সুশৃঙ্খল গণতন্ত্র’ অর্জন করতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে সরাসরি কোনও হুমকি দেননি জেনারেল হ্লেইং। তবে বলেছেন, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’
এর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ, অং সান সু চির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোমবার টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভে নামে মিয়ানমারের মানুষ। এছাড়া রাজপথে বিক্ষোভের পাশাপাশি কর্মজীবীরা দেশব্যাপী ধর্মঘটে নামায় আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা।
স্বাভাবিকভাবে অভ্যুত্থানকারী শীর্ষ এই সামরিক কমান্ডার টানা তিনদিন ধরে বিক্ষোভ চালিয়ে আসা মানুষের উদ্দেশে কী বলেন; সেটা শুনতেই অনেকে মুখিয়ে ছিলেন। এছাড়া আবেগের বশবর্তী হয়ে আন্দোলন না করে বাস্তব ও সত্য ঘটনা জেনে সেই অনুযায়ী চলতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সুত্রঃ ঢাকা পোষ্ট।