মোঃ আসাদ উল্লাহ তুষার
ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ী দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী এবং সমাজ সমালোচক.বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল এর নামানুসারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অতি প্রিয় ছোট সন্তানটির নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল এর একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। তাই প্রিয় লেখকের নামানুসারে প্রিয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন। যে সন্তানের জন্ম ও বেড়ে উঠার সময়ে যাকে পাকিস্তানের স্বৈরচারীশাসক গোস্টির অন্ধকার কারাগারে থাকতে হয়েছে। জন্মের পরে পাঁচ ছয় বছর পর্যন্ত পিতার আদর,ভালবাসা, স্নেহ মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন যে শিশুটি তাঁকেই কিনা ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারাতে হল। সমসাময়িক ইতিহাসে নির্মম নিঃসংশ হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়ে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ রহমানের সাথে তাঁর প্রিয় দশ বছরের আদরের ছোট সন্তান শেখ রাসেলকেও নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছিল। বাবা,মা,ভাই,ভাবী,আত্মীয় পরিজনদের সাথে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন শিশু শেখ রাসেল ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে। বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। প্রাণভয়ে বাড়ির কর্মচারীরা শেখ রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে খুনিরা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি মায়ের কাছে যাব”। পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন “আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও”। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির তত্বাবধায়ক এএফএম মহিতুল ইসলামকে জাপটে ধরে সেদিন শিশু রাসেল বলেছিল, ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো? রাসেল তখন কান্নাকাটি করছিল আর বলছিল যে ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব’। এক ঘাতক এসে ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি’ এই বলে রাসেলকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে শেষ করে দেয় বঙ্গবন্ধুর আদরের রাসেলকে।
ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন শেখ রাসেল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শেখ রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। ভাই-বোনের মধ্যে বড় বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল এবং ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পঞ্চান্ন বছর বেঁচেছিলেন । বেঁচে থাকলে রাসেলের বয়স হতো আজ ৫৭। শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে কি তাঁকে বঙ্গবন্ধুর মত দেখা যেত। এমন লম্বা সৌম্য সুন্দর চেহারার ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হতেন শেখ রাসেল, ব্যাক ব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুলে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরা শেখ রাসেল কি দেশের এক সময় নেতৃত্ব দিতেন? হয়তো তাই, দিতেন আর সে কারনেই ঘাতকেরা সেদিন জাতির পিতার সাথে তাঁকেও হত্যা করে ।
সকল ধর্মে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে নারী ও শিশু হত্যাকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সব ধর্মেই নর হত্যা মহাপাপ। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও শিশু হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। নবী করীম (সা:) বলেছেন, কিয়ামতের দিনে মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিচার করা হবে, তা তাদের মধ্যে সংঘটিত রক্তপাত ও হত্যার বিচার। (বোখারী, মুসলিম) তাই যারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে অবলিলায় শিশু হত্যা করছে তারা নি:সন্দেহে ভ্রান্ত পথের অনুসারী এবং এ পথ গিয়েছে জাহান্নামের দিকে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এসব লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘ তাদেরকে যখনই বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না’ তখনই তারা বলেছে, ‘আমরা তো সংশোধনকারী মাত্র।’ (সূরা বাকারা-১১)। খুনিদের কাছে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বিবেক বুদ্ধি কোন কিছুরই বালাই ছিল না, তারা পশু হয়ে গিয়েছিল।
পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে বাড়ির সবাই শহীদ শেখ রাসেলকে অনেক আদর করতেন। মা, ভাই বোনদের পাশাপাশি দাদা দাদিও খুব আদর করতেন, রাসেলকে পিতা বঙ্গবন্ধু একটু বেশিই আদর করতেন । কারন জন্ম ও বেড়ে উঠার একদম শিশুকাল থেকেই পিতার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল ছোট্ট রাসেল। ঐ ছোট্ট বয়সে বাবাকে বলতে গেলে চিনতেনই না । স্বাধীনতার পর ‘৭৫ পর্যন্ত হয়তো সেজন্যই প্রায় সময়ই সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেলকে নিজের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করতেন । কিন্তু ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁকেও রেহাই দেয়নি । কি অপরাধ ছিল তাঁর ? আসলে পচাত্তরের পনেরই আগস্টের শহীদদের কারোই কোন অপরাধ ছিল না । দেশি বিদেশী চক্রান্তে বাংলাদেশকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে খুনি খোন্দকার মোস্তাক -ফারুক – রশিদ , জিয়া চক্ররা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার আত্মীয় স্বজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা সেদিন কোন ব্যক্তিকেই হত্যা করেনি, তারা সেদিন হত্যা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, গনতন্ত্রকে, মানববতাকে । তা না হলে চার বছরের শিশু থেকে নব বিবাহিত বধু ও অন্তসত্বা নারীকে তারা কিভাবে হত্যা করে? শুধু তারা হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি এর যেন বিচার না হয় তারজন্য অবৈধ ক্ষমতা দখলদার খুনি মোস্তাক – জিয়া ইনডেমনিটি আইন করে বিচারের পথ বন্ধ করে রেখেছিল।
শহীদ শেখ রাসেল হতে পারেন আগামী দিনের শিশুদের প্রেরণা । জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতির পুত্র হয়েও যে সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে তাঁর পথচলা শুরু হয়েছিল, সাধারণ মানের স্কুল, সাদামাটা জীবন যাপন, আর দশটা সন্তানের মতই রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ানো এবং পারিবারিক শিষ্টাচার ও আদব কায়দার যে উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন তা আগামী দিনের শিশুদের চলার পথের বিরাট এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত । মাথাভর্তি কালো চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার শেখ রাসেলও যে বেঁচে থাকলে একদিন দেশের নেতৃত্ব দিতে পারতেন, ঘাতকরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। আর তাই বিশ্ব বিবেককে স্তব্দ করে দিয়ে নিষ্পাপ চেহারার স্নিগ্ধ দশ বছরের এমন এক মিষ্টি চেহারার শিশু বাচ্চাকে ব্রাশফায়ার করে তুলতুলে দেহটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। কেমন লেগেছিল, কেমন লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর আদরের রাসেলের! আর কেমনই লেগেছিল বর্বর নরপিচাশ ঐ খুনিদের ? ওদের কি বুক কাপেনি একবারও ? কাপেনি; কারন ওরা অমানুষ ওদের পরিচয় ওরা খুনি । তাই ওরা বঙ্গবন্ধুকে,তাঁর স্ত্রী মহীয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে,জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও শেখ জামালকে ও তাঁদের নব পরিণীতা স্ত্রীদেরকে যাঁদের মেহেদীর রঙয়ে রাঙ্গানো ছিল হাত তাঁদের হত্যা করেছে। ওরা সেদিন হত্যা করেছে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে, শহীদদের রক্তে রঞ্জিত লাল সবুজের পতাকাকে । এমন একটি সম্ভাবনাময়ী প্রতিভাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অপ্রস্ফুটিতই থেকে গেল এমন একটি প্রতিভা।
কিন্তু খুনিরা শেখ রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করলেও ভাগ্যগুনে বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া তাঁর দুই বোন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রদ্ধেয় শেখ রেহানা আজ দেশকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁর বড় দুই বোন কি অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করে আজ দেশকে নিয়ে উন্নয়নের পথে যে যাত্রা শুরু করেছেন বেঁচে থাকলে শেখ রাসেলও তাঁদের বোনদের এই যাত্রায় শরীক থাকতেন । মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হয় না । খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ টিকে আছে এবং থাকবে। সেই আদর্শকে সামনে নিয়ে দেশকে পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা । শহীদ শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে । খুনিদের অনেকের ফাঁসি হয়েছে। খুনিদের আস্ফালন ধুলোয় মিশে গেছে। বাঙালি আজ কলংকমুক্ত হয়েছে । নিশ্চয় শহীদ শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু সহ পরিবার পরিজনদের আত্না কিছুটা শান্তি পাচ্ছে।
শহীদ শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্মদিনে তাঁর শিশুকালের দুরন্তপানা, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা আর দুষ্টুমিতে একাকার হয়ে যাওয়া, পিতা বঙ্গবন্ধুর মতই প্রিন্স কোট বা ওভার কোট পরে হাতের আঙ্গুল ধরে হেটে যাওয়া বা ঈদের জামাতে নতুন পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে ইদ্গাহে যাওয়া বা বিদেশ সফরে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে কোন বিষয়ের উপর জানতে চাওয়া এসবেরই স্মৃতিকথা হতে পারতো । কিম্বা বড় হয়ে জগত বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মত হওয়া বা হতে চাওয়ার ইতিহাস থাকতো। তার সবকিছুই শেষ হয়ে গিয়েছে পচাত্তরের পনেরই আগস্টের কালো রাত্রে! বেঁচে থাকলে শহীদ শেখ রাসেল আজ বঙ্গবন্ধুর বয়সী হতেন বা দুই বছরের বেশী বয়সী থাকতেন।
সুখের বিষয় বর্তমান সরকার শেখ রাসেলের জন্মদিনকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। দিবসের প্রতিপাদ্য “শেখ রাসেল দীপ্ত জয়োল্লাস”। শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিনে এটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্মান। কারণ তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। এই পৃথিবীর আলো বাতাস, পৃথিবীর সৌন্দর্যের রুপরস, তাঁর হাসু আপার নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ টুঙ্গিপাড়ার মধুমতি নদীর বদলে যাওয়া সৌন্দর্য আর বাঙালির অকৃতিম ভালবাসা নিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে যিনি বেড়াতেন এখন তিনি কোথায় আছেন? নাবালক শিশুবাচ্চা শেখ রাসেলকে খুনিরা হয়তো হত্যা করেছে কিন্তু তিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে গেছেন এবং হয়তো তাঁর সুশীতল ছায়াতলে তাঁর পিতামাতা ও স্বজনদের অপেক্ষায় আছেন। মহান আল্লাহতায়ালা পরকালে তাঁকে হয়তো তাঁর পিতামাতা আত্মীয়স্বজনদের সাথে উত্তম প্রতিদান জান্নাতুল ফেরদৌস দিবেন। মহান আল্লাহর দরবারে সেই ফরিয়াদ জানাই । শুভ জন্মদিন শহীদ শেখ রাসেল । যেখানেই থাকুন আপনি ভালো থাকুন।
লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য,
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।
ই-মেইল:asadullahtushar@gmail.com