1. successrony@gmail.com : Mehedi Hasan Rony :
  2. arif_rashid@live.com : Arif Rashid : Arif Rashid
  3. meherunnesa3285@gmail.com : Meherun Nesa : Meherun Nesa
বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪, ১১:৩১ অপরাহ্ন

এমপি এনামুল বিতর্কে এলেন, বিতর্কেই আছেন

দিনলিপি নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৮ জুন, ২০২০
  • ৬৬৯ বার

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুকে একের পর এক আপত্তিকর পোস্ট এবং কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি এনামুল হকের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী আয়েশা আক্তার লিজার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারপর এলাকায় নানা কারণে তিনি ছিলেন আলোচনায়। নিজে যেমন নিয়োগ বাণিজ্য, দ্বিতীয় বিয়ে, জঙ্গিদের নেতৃত্বে এনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি দলের একটি অংশ সব সময় তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে আছে। ফলে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এমপি এনামুলের।

ব্যবসায়ী এনামুল হক ২০০৮ সালে রাজশাহী-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। সিনিয়র অনেক নেতাকে পাশ কাটিয়ে তার মনোনয়ন পাওয়া ছিল রীতিমতো চমক।

স্বামী দাবি করে ফেসবুকে নারীর পোস্ট : এমপি এনামুল হককে স্বামী দাবি করে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন এক নারী। লিজা আক্তার আয়েশা নামের ওই নারী নিজেকে এমপির স্ত্রী দাবি করছেন। ওই নারীর বাড়ি নগরীর তেরখাদিয়া এলাকায়। এনামুলের সঙ্গে যুগল একাধিক ছবিও তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে।

তবে এনামুল হক দাবি করেছেন, ওই নারীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। আইনগতভাবে ডিভোর্সও হয়েছে। নানা সময়ে টাকার জন্য ব্ল্যাকমেইল করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে তার সম্মানহানি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।

গত ৩০ মে লিজা আক্তার আয়েশা প্রথম ফেসবুকে লিখেন, ‘এমপি সাহেবের রক্ষিতা বা প্রেমিকা নই, দ্বিতীয় বউ আমি।’ আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেন, ‘এমপি সাহেব আমার হাজব্যান্ড (স্বামী) এই কথাটা যদি কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়, তারা বিয়ের কাগজ দেখতে পারেন।’ এর দুই ঘণ্টা পরে আরেক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘একজন সংসদ সদস্য অনেক বড় অবস্থানের মানুষ। তার বিরুদ্ধে চাইলেই কেউ মিথ্যা অপবাদ দিতে পারে না। আমার কথাগুলো যদি মিথ্যা হতো তাহলে এতক্ষণে পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে যেত। আমি যা কিছু বলছি এবং বলব সব সত্যি। আপনারা আমাকে বিরক্ত না করে ধৈর্য ধরে পাশে থাকুন।’ এরপর এনামুলের সঙ্গে একাধিক ছবিও পোস্ট করেন লিজা।

লিজা আরেকটি পোস্টে লিখেন, ‘২০১৮ সালের ১১ মে আমাদের বিয়ে হয়। প্রথমে আট বছর আগে আমাদের বিয়ে হয় মৌখিকভাবে। তার বাগমারার বাড়িতে। কিন্তু লিখিত বিয়ের পর গত দুই বছর ধরে তিনি আমাকে গোপনে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে আসছেন। এখন তিনি একটি ভুয়া কাগজ করে আমাকে তালাক দিয়েছেন। সেখানে আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এ কারণে আমি পরিস্থিতির শিকার হয়ে ফেসবুকে এসব কথা বলেছি। আমি সংসার করতে চাই আমার স্বামীর সঙ্গে।’ এই প্রতিবেদককে ফোন করে লিজা আক্তার আয়েশা এমপি এনামুলকে নিজের স্বামী দাবি করে বলেন, ‘আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাই।’ মামলা করছেন না কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আদালত খুললে মামলা করব।’

লিজার বিরুদ্ধে মামলা : এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অপপ্রচারে’র অভিযোগে লিজার বিরুদ্ধে এমপির পক্ষে মামলা করেছেন তার একান্ত সহকারী ও বাগমারা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ। বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর এমপি এনামুল হকের পক্ষে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ও চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। এতে আসামি করা হয়েছে এনামুল হকের তালাক দেওয়া দ্বিতীয় স্ত্রী আয়েশা আক্তার লিজাকে। মামলায় বলা হয়েছে, আয়েশা আক্তার লিজাকে তালাক দেওয়ার পর তিনি এমপি এনামুল হকের কাছে নিজের ব্যাংক লোনের এক কোটি টাকা পরিশোধের জন্য চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবি দিয়ে এনামুল হকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তার সুনাম ক্ষুণœ করেছেন।

এমপি এনামুলের ডিওতে (চাহিদাপত্র) ৫০ দফতরি নিয়োগ : রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘দফতরি কাম প্রহরী’ পদে ৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই ধাপে এ নিয়োগ হয়। নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রার্থী নির্বাচনে কমিটির কোনো ভূমিকা ছিল না। বাগমারা-৪ আসনের এমপি এনামুল হক নিয়োগের আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) লেটার পাঠাতেন। কোন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে চিঠিতে তার উল্লেখ থাকত। সে তালিকা ধরেই প্রার্থী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে কমিটি।

অভিযোগ আছে, নিয়োগ দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে এনামুল হক চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। সে হিসাবে অন্তত দুই কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা টাকা দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন। সংশ্লিষ্ট ইউএনও ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন যে কেবল এমপির মনোনীত প্রার্থীদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বাগমারার ইউএনওর দফতর ও প্রাথমিক শিক্ষা দফতর সূত্রমতে, উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ২১৪টি। প্রথম পর্যায়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে ২০টি স্কুলে দফতরি কাম প্রহরী পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এনামুল হক পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে ১৩ জুলাই তৎকালীন ইউএনও সাদেকুল ইসলাম এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে একটি ডিও লেটার দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আপনার শুভ দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানাচ্ছি যে, আমার নির্বাচনী এলাকা ৫৫, রাজশাহী-৪, বাগমারা উপজেলার অন্তর্গত নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধীনে দফতরি কাম প্রহরী পদে নিয়োগ দানের জন্য সুপারিশ করা হলো। আমার বিশ্বাস, তাদের উক্ত পদে নিয়োগদান করলে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে।’ ২০টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন অন্তত ৮০ জন প্রার্থী। কিন্তু নিয়োগ কমিটি এমপির মনোনীত ২০ জন প্রার্থীকেই নিয়োগ দেয়।

২০১৪ সালের শুরুর দিকে দ্বিতীয় ধাপে ৩২টি স্কুলে একই পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত ২২ জানুয়ারি এনামুল হক তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে ফের ইউএনও ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর দুটি ডিও লেটার দেন। ইউএনও বরাবর পাঠানো ওই কপিতে দেখা যায়, একটি ডিও লেটারে ১৯টি স্কুলের নাম এবং তার মনোনীত ১৯ প্রার্থীর নামের তালিকা ছিল। আরেকটিতে ১৩ স্কুলের নাম এবং মনোনীত প্রার্থীদের নাম ছিল। এ বিষয়ে ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল জব্বার জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর (এমপি) কথার বাইরে গিয়ে নিয়োগ দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। কাজেই এমপির দেওয়া আলাদা তিনটি ডিও লেটারের তালিকা ধরেই সবগুলো স্কুলেই দফতরি কাম প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে।’

তবে এসব নিয়োগে বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করেছেন এমপি এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘ওই সময় দলীয় কিছু লোকের জন্য ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। তবে কারও কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হয়নি। যাদের ডিও দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই যোগ্য প্রার্থী।’

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, টাকা ছাড়া চাকরি হয়েছে এমন নজির কমই আছে। বেশির ভাগ নিয়োগ পেয়েছে জামায়াত-বিএনপির লোকজন। শুধু চাকরি নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে বিএনপি-জামায়াতের লোকদেরই বসানো হয়েছে। যোগীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জানান, এনামুল হকের সাড়ে ১০ বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার মাধ্যমে কারা নিয়োগ পেয়েছেন খোঁজ নিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

তিনি জানান, বীরকুৎসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকার আলী আলিমের জন্য তিনি তদবির করতে গিয়েছিলেন এনামুল হকের কাছে। এমপি তখন সরাসরি ২০ লাখ টাকা চেয়ে বসেন তার কাছে। এমপি তাদের বলেছিলেন, ‘অনেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চাচ্ছে, তুমি যেহেতু এসেছো ৫ লাখ ছাড় দিচ্ছি।’ শেষে রফা হয় ১৫ লাখ টাকায়। নিয়োগের আগেই এনামুল হকের হাতে টাকা তুলে দিয়ে তবেই নিয়োগ পান জুলফিকার আলী আলিম। জুলফিকার আলী আলিম নিজেও টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

বলয়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জামায়াতের পক্ষে সদা সক্রিয় জুয়েল মিয়াকে। তার বাড়ি ক্যাচমেন্ট এলাকার বাইরে অবস্থিত ডোখলপাড়া গ্রামে। অথচ ওই স্কুলে চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা তদবির করেছিলেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সাগর। ভাগনদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিএনপির সক্রিয় এক কর্মীকে। অথচ এই নিয়োগের জন্য আরও তিনজন প্রার্থী ছিলেন। যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রাজ্জাক সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে চাইলেও তার নিয়োগ হয়নি। কাতিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিএনপি নেতা মজিবর রহমানের ছেলে মিল্টনকে। এলাকায় চাউর আছে, তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জঙ্গি মদদের অভিযোগ : এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে বাংলাভাইয়ের সহযোগীদের দলে ভেড়ানোসহ চরমপন্থিদের মদদের অভিযোগ তুলেছে বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ। উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃৃত সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টুসহ দলের কয়েকজন নেতা ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মহানগরীর একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করেন। বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সোবহান।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাগমারা আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে বাংলাভাইয়ের ক্যাডার ও ছাত্রশিবিরের সাবেক উপজেলা সভাপতি আলতাব মোল্লা, উপজেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি নুরুল ইসলামসহ অনেককে দলের নেতৃত্বে এনেছেন এনামুল। বাংলাভাইয়ের সহযোগী জেএমবি ক্যাডার মামুন মুহুরী, আবদুস সাত্তার, লুৎফর রহমানসহ কয়েকজনকে ডিও দিয়ে কারাগার থেকে তিনি ছাড়িয়ে এনেছেন বলে অভিযোগ করেন সোবহান। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পুলিশের তালিকাভুক্ত জেএমবির সদস্য আবদুস সালাম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান।

তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ জানান, বাংলাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন আবদুস সালাম। এলাকার মানুষকে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে সে। তার নির্দেশে আওয়ামী লীগের অনেককে তখন হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্যেই আবদুস সালাম এমপি এনামুল হকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক হন। তবে জেএমবি সদস্য হিসেবে এখনো তিনি তালিকাভুক্ত আছেন। তিনি বলেন, ‘তৃণমূলের মতামত ছাড়াই জেলা আওয়ামী লীগ ও এমপি এনামুল হককে ম্যানেজ করে মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবদুস সালাম।’ যদিও পরে দলীয় প্রধান আবদুস সালামের মনোনয়ন বাতিল করেন।

তবে এনামুল হক দাবি করেন, তিনি এমপি হওয়ার পর এলাকায় জেএমবি ও সর্বহারারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। আগে যেখানে বাগমারায় প্রতিদিন হত্যাকান্ড ঘটত, সেখানে একটিও এমন হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেনি। বরং যারা অভিযোগ করছেন, তারাই জঙ্গি আর সর্বহারাদের মদদ দিয়ে অর্থ আয় করেছেন।

এমপি এনামুলের আরও কীর্তি : এনামুল হকের বিরুদ্ধে আছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। আছে তার প্রতিষ্ঠান এনা প্রপার্টিজের উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পের কাজ ফেলে চলে যাওয়ার দুর্নাম। পাশাপাশি ১৬ তলা রাজশাহী সিটি সেন্টারের কাজ অর্ধেক করে ফেলে রেখেছেন প্রায় আট বছর। যদিও সিটি সেন্টারের কাজ কিছুদিন আগে আবারও শুরু করেছেন তিনি। এসব ঘটনায় তাকে নিয়ে সরকারও বিব্রত।

এমপি এনামুলের বিরুদ্ধে কথা বললেই মামলা : এনামুল হকের দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ভবানীগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি নাহিদুজ্জামান নাহিদ। এতে এমপি সমর্থকদের রোষানলে পড়েন তিনি। এমপির ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ও বাগমারা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ আইসিটি আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় ৯৬ দিন জেলহাজতে ছিলেন নাহিদ। জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, ‘এমপির বিয়ে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় আমি জেল খেটেছি। তবে এখন এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি এমনিতেই অনেক বিপদ পার করেছি। আমাকে সবাইকে নিয়ে চলতে হবে।’

তালাকের পর দ্বিতীয় দফায় দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি জনসম্মুখে আনায় এরই মধ্যে লিজার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। মামলায় লিজার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা চাঁদা চেয়ে এমপিকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শুধু ছাত্রলীগ নেতা নাহিদ ও লিজাই নন, এমপি এনামুলের বিপক্ষে যারাই অবস্থান নিয়েছেন, তাদের নামেই দেওয়া হয়েছে মামলা। আর তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর সংখ্যা-ই বেশি। গত প্রায় ১১ বছরে অন্তত ২০টি মামলা দায়েরের তথ্য দিয়েছেন ভুক্তভোগী নেতা-কর্মীরা। এসব মামলায় অন্তত অর্ধশত নেতা-কর্মীকে কারাবরণ করতে হয়েছে।

বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন এমপি এনামুলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পৌর মেয়র কালামের গ্রুপে থাকায় তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় তিনটি মামলা। যোগীপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে একটি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মতিউর রহমান টুকুর বিরুদ্ধে একটি (টুকু এখন এমপির ঘনিষ্ঠ), বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আকবর আলীর বিরুদ্ধে একটি এবং আওয়ামী লীগ কর্মী আক্কাছ আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, এভাবে বাগমারায় গত ১১ বছরে অন্তত ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে এমপি এনামুলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায়। তাদের বেশির ভাগকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি মেয়র কালামের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আমাকে নানাভাবে হয়রানি করেছেন এমপির লোকজন। আমার নামে দেওয়া হয়েছে চারটি মামলা। এসব মামলায় আমার ১০-১২ জন নেতা-কর্মীকে জেল খাটতেও হয়েছে।’

তবে এমপি এনামুল হক বলেন, ‘বাগমারায় যারা বিভিন্ন অপরাধ করেছেন, তাদের নামে সেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে। এখানে আমার কারণে কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। আমি কাউকে মামলা করার পরামর্শ দিইনি।’

অবৈধ সম্পদ ২ হাজার ১২০ কোটি টাকার : এনা প্রপার্টিজের মালিক এমপি এনামুল হকের নামে ২ হাজার ১২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নির্বাচনী হলফনামার সম্পদের তথ্য যাচাই করতে গিয়ে ওই পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপ-পরিচালক যতন কুমার রায়। এ পর্যায়ে এনামুল হকের কাছে সম্পদ বিবরণীর হিসাব চাওয়ার অনুমতি চেয়ে ২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চার পৃষ্ঠার প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছিল কমিশনে।

সূত্র জানায়, কমিশন প্রতিবেদনটি যাচাই শেষে এনামুল হকের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস পাঠিয়েছিল। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮-০৯ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে তিনি সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তার নামে ১১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠানের আয়; যা দুদক আইন পরিপন্থী।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, এনা প্রপার্টিজের নিজস্ব ভবনসহ ১৭টি আবাসন প্রকল্প আছে। যার বর্তমান মূল্য ২ হাজার ১২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই অর্থের বৈধ উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এনামুল হকের মালিকানাধীন এনা প্রপার্টিজে তার ও তার স্ত্রী তহুরা হকের আনুপাতিক শেয়ার ৪:১। এনা প্রপার্টিজের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় জমা দেওয়া অডিট প্রতিবেদন ও ব্যাংক ঋণ নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে দাখিল করা অডিট প্রতিবেদন আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তিনি ৩১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা গোপন করেছেন; যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত। একই সঙ্গে ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে তার দুই ছেলেকে সালেহা ইমারত কোল্ড স্টোরেজ থেকে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার শেয়ার প্রদান করা হয়েছে, তা আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনামুল হকের হলফনামায় বলা হয়, ২০০৮ সালে শুধু বেতন-ভাতা থেকে তার বছরে আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পর এখন কৃষি, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা ও পেশা থেকে বছরে তার আয় হয় ৫০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে তার পরিবারের পোষ্যদের ৭ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ টাকা বার্ষিক আয় থাকলেও এবারের হলফনামায় পোষ্যদের কোনো আয়ের উৎস নেই বলে উল্লেখ করা হয়। তার নিজের, স্ত্রীর ও অন্যদের মোট ১৬ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাধারণ শেয়ার থেকে কোনো আয় নেই উল্লেখ করা হয় হলফনামায়। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে থাকা ২ কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। নিজ নামে ব্যাংকে আছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৯১ টাকা ও স্ত্রীর নামে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা।

এনামুল হক অবশ্য জানিয়েছেন, তার এই সম্পদের হিসাব ৬ বছর আগের। দুদক যা জানতে চেয়েছিল, তিনি তার জবাব দিয়েছেন। নিজের কোনো অবৈধ সম্পদ নেই বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে, লিজার অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান দিল সেতারা চুনি বলেন, প্রতারণামূলক বিয়ে, বাচ্চা নষ্ট করা এবং রাজনৈতিক কারণে বিয়ে গোপন করতে বলে লিজার সাথে ঘর সংসার করেন এমপি এনামুল হক। পরে যখন সন্তান এবং স্বীকৃতি দাবি করেন, তখন লিজার স্বাক্ষর জাল করে একটি তালাকের কাগজ দেখান। এতে বলা হয় লিজাই তালাক দিয়েছেন। পরে বলা হয় এনামুল হক তালাক দিয়েছেন। এরপর থেকেই এনামুল হকের অনুসারীরা লিজাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, তারা নিজেরা দুজনই বিবাহিত ছিলেন। দুজনই বিয়ে করেছেন। এখন তাদের কাগজপত্র যাচাই করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাগজ পর্যালোচনা করছি আমরা।

এ জাতীয় আরো সংবাদ