1. successrony@gmail.com : Mehedi Hasan Rony :
  2. arif_rashid@live.com : Arif Rashid : Arif Rashid
  3. meherunnesa3285@gmail.com : Meherun Nesa : Meherun Nesa
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২০ অপরাহ্ন

কমলের পত্র

সিফাত হালিম, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ৭০৩ বার

স্নেহসিক্ত কমল,

তোর আক্ষেপ আছে, আমি কিছু হতে পারলুম না,
অভিমান ও করিস যখন তখন
তোকে পত্র দিইনা ,
মাঝে মাঝে শুনতে পাই,
ইথারে ভেসে আসে শব্দেরা এতো দ্রুত, ক্রমাগত,
তোর অসীম আয়তনের খ্যাপাটে ভাবনা,
স্মৃতির ইন্দ্রজালে কবিতার হারানো পংক্তি গুলো ফিরে পাওয়ার মতো, আমার সম্যক দৃঢ়তা উল্টে দেয়।
তুই লিখেছিস, তুমি কবি হয়েছ, সিগ্রেট খাওনা, ভালো আছো নিশ্চয়ই?
কমল, আমি আপন ভুবনে নির্বাসিত,কবিতা লেখা ছেড়ে দিইছি আর সিগ্রেট ছাড়তে পারিনি বরং ইদানীং বেড়ে গেছে।
আছি কেমন?
আমি এখন রেসের বাতিল খোঁড়া ঘোড়া,
বুক পকেটের খাতা ধুলোয় আচ্ছন্ন, ঝরনা কলমে জং।
তোর আক্ষেপ সঠিক, আমি কবি হতে পারিনি,
চির বুভূক্ষ সাধটা রয়ে গেছে,
কবিতার সত্যি ডানা ছিল, কি জানি ছিল বুঝি,
নইলে পংক্তিরা এতো চটজলদি আলাদা হয়ে গেল , কেমন করে অদূরের যুতসই দালানে দাঁড়ালো সটান।

তোর মনে নেই, জোছনায় আবেগের ডাকবাক্স ভর্তি শত কবিতা নিয়ে,
পেছনের গলিতে দেখা করতে যেতাম কখনো – সখনো,
তোর ঘোর ক্ষেদ, আপত্তি ছিল কবিতায়।
আসলে তোর ভালোই লাগতো, ভান করে শুধুই আড়ি নিয়েছিস, ছুঁড়ে ও ফেলেছিস কতকবার।
কমল, আমি কবি হতে পারলুম না রে, আকাশ হই।

যে আকাশের তলে আলোক ফানুস ওড়া দেখার জন্য, কোটি নক্ষত্র গোনার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম,
আমি এখন সেই আকাশেই চেয়ে, একটি নক্ষত্র খসে পড়া দেখার জন্য প্রতীক্ষা করি।
যে আকাশ দিয়ে হাওয়াই জাহাজে চড়ে তুই বিলেত গেলি, সবার আগে সেই আকাশে ভেসে আমার সাত সমুদ্দুর পাড়ি দেবার কথা। উত্তাল স্বপ্ন ছিল স্কলারশিপ নিয়ে নিউইয়র্ক,
বছর খানেক পরে এসে তোর দখল নেবো,
সানাই বাজবে, ঢাক-ঢোল, কত বাদ্য- বাজনা।
দিন – ক্ষণ সব ঠিকঠাক,
কিন্তু কি যে এক কাল রোগে ধরলো আমায়,
মাহেন্দ্রক্ষণে হঠাৎ দেখি পা দুইটি অবশ,
আমাদের ইচ্ছেরা ওলোট পালোট,,

বাবা কার্পণ্য করেনি, বছর ধরে স্রোতের মতো টাকা গেল, গোলার মজুত ধান গেল, গোহালের দুগ্ধবতী সিধু-মধু গেল, দশ কোর জমি ছিল আর ছিল দক্ষিণে পোতার বড়ো দু’খানা টিনের ঘর, সুদের দায়ে তাও গেল মহাজনের কব্জায়।
তুই অনেক ঠাকুর – দ্যাবতার পায়ে মাথা কুটলি, পূঁজো, মানত দিলি,
আর মা, সেই থেকে কেঁদেকেটে চোখ হারালো।
তারপর বছর ঘোরেনি,

এক শীতে দেখি সানাই বাজছে , শঙ্খের সাথে উলুধ্বনি,
টোপর পরা অচেনা হাত ধরে পেছনের গলি দিয়ে লহমায় তুই দেশান্তরি ।
চলে যাবিই হয়তো, আমি কি খুব বেশী বদলে গিয়েছি,
মাত্র পা দু’খানা ছাড়া?
নইলে কেন চেনা গলিতে মিনিট দুই একটু থমকে দাঁড়ালি না?
কি এমন দোষের হতো , যাবার কালে মুহূর্ত মাত্র দেখা দিলে ?
তোকে নিয়ে অভিমানী এ দারিদ্র ঘুচবে না, কিছুটা অভিযোগ তো ভাঙতো।
আমি নাহয় ইট্টুসখানি ললাট ছুঁইয়ে করতলে , কবির ভাষায় বর দিতাম, “ভালোবেসে যে আমায় কবি বানালো, সে যেন আজ সুখী হয়, সুখেই থাকে।”
সেই থেকে অভিমানী ডাকবাক্স আর খুলিনি রে , তালা ঝুলছে , বন্ধ হয়ে গেছে কবিতার আনাগোনা।

তুই নাকি খুব সুখেই আছিস গাড়ি – বাড়ি-জড়োয়ায়,
তোর ফাটা কপাল, আর হবে না বা কেন?
মাটির ভগবানের কাছে বরাবরের প্রার্থনা, আমি কোটাল পুত্র অতি নগন্য কিন্তু আমার কোমল চিরসুখী যেন পূর্ণতায় এক পূর্ণ চাঁদ, সে যেন রাজরানী হয়।
অবশ্য কপাল বলে কিছু নেই, মানিও নি কখনো,
তোর আবার ঠাকুর দ্যাবতায় খুব ভক্তি,শাস্ত্র মানিস, সময় অসময়ে উপোস দিস।
এইসব ভাগ্য কপাল নিয়ে আমাদের অনেক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা কথায় কথায়,
অবশেষে পাততাড়ি গুটিয়েছি আমিই,
হাসতে হাসতে বিঘত খানেক মুখের ম্যাপে চার আঙ্গুল চওড়া তোর কপালে হাত বুলিয়েছি বহুবার,
কয়েকটি লম্বা রেখা ছাড়া দৃষ্টে কিছুই বাঁধেনি আর ।
ঈশ্বর ভগবানকে মানতাম না, কিন্তু অস্বীকার করিনি কখনো, এখন একটু বেশি ঝুঁকিছি যখনই হারুর খবর শুনি । হারু, হারাধনটা কে? সবুর কর বলছি পরে।
লিখেছিস, কেমন আছি, সবার বিস্তারিত যেন বলি?
আমি যে খুব বেশি কষ্টে আছি তা কিন্তু না,
লোকে বলে ভাঙা কপাল জোড়া লাগে না।
আমার এমনই কপাল,
হতচ্ছাড়া পুরনো সেই পৃথিবী, বাবা গত হয়েছেন, মা অশীতিপর বৃদ্ধা, লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে।
এসব তোকে বলেনি কেউ?
কে আর বলবে ?
বাড়ি ছাড়া তুই অনেক দিন, সেটাও হলো বছর তিন,
তোর ভুলো মন,
সব আমার মনে আছে রে ।

আমাদের গোবর লেপা ফকফকা উঠোনের কোনায় কুল গাছটা তেমনি দাঁড়িয়ে, জামরুলের ফুল এসেছে, থোকায় কিছু জামরুল, কদবেলও ধরে, বেলি, গাঁদা, জবা এখনও ফোটে অজস্র।

আমরা মা-পুতে মিলে বেশ আছি, খাই – দাই, যখন যেভাবে পাই সেভাবেই,
আমি ঝোল, ভাজি-ভুজি, নাবড়া রাধতে পারিনা,
উদোর পূর্তিতে ঝোলাগুড়ে রুটি ভিজিয়ে গিলি।
ও পাঁড়ার হেলার মা, মোসলমানের বৌ, তাতে কি?
মানুষ বলে ওরে,
বাছ-বিচার নেই, দয়া ধম্মো জানে ,
মুখ বুজে রোজ এসে কাজ করে।
উনুনের মুখে লাকড়ি গুঁজে রুটি সেঁকে দেয় ক’খানা,
তুলসী তলায় সান্ধ্য প্রদ্বীপ জ্বালে, এইই বেশ।
মোসলমানের বউ হিঁদুর ঘরে আসে,
লোকে কত্তো ছিঃ ছিঃ কথা বলে, বলুক। যত্তোসব ভাঁড়ামো।
জাত যায় ,ধম্মো যায় ।
রেঁধে তো দেয় না কেউই ?
ক্ষুধার অন্ন বলে কথা।
একটা হাতে হলেই হয়।
আমরা মা-পুতে ঘাটের মড়া। ওসব জাত-পাদ ভাবলে আমাদের কি চলে?

কমল, আমি সিগ্রেট ছাড়িনি, কবি হতে পারিনি,
মাথার তলে দুহাত বেঁধে বসে বসে আকাশ দেখি,
শুধুই দেখি, আর হাওয়াই জাহাজ গুনি,
কতোটা গেছে কতোটা এলো সব মুখস্থ।
জানিস, চার চাকার চেয়ারে আমায় মানিয়েছে ভালো,
টিপ দিলে অটোমেটিক একাই গড়গড়িয়ে চলে,
সিগ্রেট মুখে আমার তখন ভারী আরাম,
নিজেকে এ যুগের রাজা মনে হয়। হাঁটাচলা নেই, এমন বাহন চেপে আয়েশে রাজারাই তো যাতায়াত করে।

আমাদের বাড়ির পাশের ভৈরব নদ বড্ড বেশী দুঃখী,
কখনও মনেহয় কাফনে জড়ানো, কখনও বেধবার সাজ,
এখন জল নেই,
দখল দূষণে বুক ভর্তি কষ্টের সাদা বালি,
সহজে পার হওয়া যায়।

সেবার ভরা জোয়ারে কাগজের নৌকা ভাসাতে গিয়েছিলুম নদে,
পা পিছলে জলে পড়ে হাবুডুবু, ভয় পেয়েছিলিস,
তোর কাজল আঁকা চোখে এমন অশ্রু ধারা,
সে কি হরদম কান্না,
কাজল ছড়িয়ে তোর সাদাটে মুখ মাখামাখি, ঠিক যেন মা কালীর মূর্তি।
আমি ভীষণ কৌতুকে হেসে উঠি,
কিন্তু মা?
মা আবার তোর চোখের জল সহ্য করতে পারে না।
সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে আরেকটু কিছু বললি,
বাড়ি ফিরলে মা এইছা পিটুনি দিল, গণহারে, থামাথামি নেই। যেন সব দোষ আমার।
আমি তো *থ*। বেত ভাঙলো ক’খান।
এই জীবনে প্রথম বেতপেটা , এখনও দাগ আছে কিছু।
বিপিন আর আমি মিলে মাঝে মাঝে যাই দুজনে,
পাড়ে গিয়ে বসি, নদ দেখি,
নদের সাথে তোর অনেক মিল,
এই সেরেছে জেন্ডার আবার গুলিয়ে যায় ,
তুই যে ব্যাকরণে অনেক ভালো। আর নদ-নদীতে কীইবা এসে গেল ?
পারলে একবার আয়, নদ দেখবি, জোছনায় হেঁটে এপার-ওপার হবি।

মা ক’টা দিন ধরে খুব ঘনঘন কাশে ,
পাশের বাড়ির বিশু কাকার রোগী অন্ত পরাণ,
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, হাত যশ আছে,
কিন্তু যেই না হাঁড় কেপ্পণ, পয়সা বলে কথা,
নিজে থেকেই মায়ের ছিরাপ দিয়ে যায় দুবেলা।
বলে, চিন্তার কিছু নেইরে সুকু, সেরে যাবে।
কিন্তু কাশিটা যে বাড়ছে ক্রমেই, আমি শুধুই ভয় কাতুর নির্বাক দেখি,
আমার একলা থাকার অভ্যেস নেইতো , ভয় অনেকখানি।
এখনও যে মা নড়াচড়া করে, সাড়া শব্দ পাই,
মা চলে গেলে বাড়িটা শব্দহীন নিঝুম প্যাতপুরী,
আমি বড়ো একা, নিঃসঙ্গ হয়ে যাবো রে,
আমার সত্যিই ভাঙা কপাল, লোকের বলা বেঠিক নয় ঠিক ।

আসল কথা, তোর খোকার নাম কিছু কি রাখলি?
শোনা হয়নি তো, এবার পূঁজোয় হলো,
মা শুনে বলেছে, ওরে সুকু, কোমলের ছেলের নাম নিয়ে বিড়ম্বনা, একখানা নাম রেখে দে,,,
তোর খোকার জন্য একটা নাম ঠিক করেছি, দ্যাখ চলে কি না? হারু, হারাধন,,,
মা শোনে আর হাসে,
নামটা ভুলিস নে যেন,
আমায় ঐ নামেতে ডাকে সবাই,
খাঁটি জিনিস চিনতে ভুল হয় না কারও ,
মুখে মুখে সুনাম
ছাত্র হিসেবে ভালো, জলপানি পাই,
লোকে বলে, হারাধনের দশ লাগে না, সুকুর মতো একটা হলেই হয়, সেই থেকে দশ গাঁওয়ের আমি এক হারু,
খোকার নাম তবে হারুই রাখিস। আর সবাই মিলে একবার বাড়িতে আসিস।
মা তোর কথা প্রায়ই বলে এটা – সেটা, তোদের দেখতে চায় বারবার।
চিনতে পারবি তো?
নাকি নতুন লোকের কাছে অচেনা বানাবি চোখের পলকে।
পাছে না বিব্রত হতে হয় আমায় । থাক, তবে তোর এসে কাজ নেই।

কমল, শীতের দেশ। আচ্ছা তোর ওইখানে বিষ্টি হয়?
এখানে বিষ্টি নাবলে মাঠে দাঁড়িয়ে ভিজিস আর বলিস,
সুকুদা, বিষ্টিতে নাইতে অনেক মজা, ভিজবে এসো।
আমার আর বিষ্টিতে ভেজা হয় না। আমি শুধুই জানালায় বিষ্টি দেখি।
তুই কি আজো বিষ্টিতে ভিজিস তেমনি?

তোকে একটা কথা বলি বলি করে বলা হয় নি,
কিছুদিন আগে মনের ডাকবাক্সটা খুলে দিইছি,
তোর আক্ষেপ অভিমান ছিল, থাকলো না।
এখন নিয়মিত পত্র পাঠা , খবর পাবো,
আমার হতচ্ছাড়া পাজি ইচ্ছেরা কবিতা লিখতে দেয় না,
তোর যা ইচ্ছে হয় তাই নাহয় লিখিস দু’ছত্র,
রঙে নীল শোকের বেদনার ,
আগুনের রঙে রঙিন লাল খামের পত্র দিস।
ওটা তেজী সাহসের।
আমি সব কাজেরই ভীতু,
তুই আমাকে সাহসী হতে বলিস, পারিনি,
একবার দ্যাখ, ভালোবেসে ঠিক ঠিক পারি ,
আহত তাতে কি, আমি এখন অপেক্ষার সাহসে জ্বলে পুড়ে সাহসী ।

সবশেষে তোর সুখে থাকার খবরে মা বেজায় খুশী, আমি,
কী মুশকিল, হিংসা হবে কেন পাগলি, বরং ভয় বেড়েছে,
কারণ সুখের আয়ু স্বল্প , দুখের দীর্ঘায়ু। তবে যে আমার লম্বা উমোর,
দীর্ঘদিন কি হবে?
কোনো লাভ নেই?
আমার খুব তাড়া আছে,
তোকে দিয়ে দিলুম।
হারুদের মুখের বুলি শোনার জন্য একটু বেশী পৃথিবীতে বাঁচা তোদের প্রয়োজনীয়।
ঈশ্বর ভগবান মানিনি, এখন থেকে হারুর জন্য মানবো,
তোর গা ছুঁয়ে দিব্যি দিলুম মানবো।
আমার খুব তাড়া আছে রে, চটজলদি আসিস, তোকে একটিবার দেখার জন্য অপেক্ষায় রইছি ।

তোর সুকু’দা

(সমাপ্তি)

এ জাতীয় আরো সংবাদ