মধ্যাহ্ন ভোজে বসেছি। সামনের টেবিলে ঢাকা দেওয়া পাত্রে ধোঁয়া ওঠা স্যুপ রয়েছে। খাওয়ার প্রবৃত্তি নেই।যাহোক, বাটিতে অল্প পরিমাণে স্যুপ তুলে নিলাম। একটু পরে (ডাক্তারের মতো) সাদা রঙের লম্বা অ্যাপ্রোন গায়ে, হাসিমুখে ওয়েটার এসে দাঁড়ালো। স্টিলের চকচকে ট্রেতে করে পূর্ব নির্ধারিত মেন্যুর গরম গরম খাবার নিয়ে।’গুটেন তাগ’বলে ঝটিতি পরিবেশন করলো সেসব। তারপর যাবার সময় বলে গেল, “গুটেন আপেতিত। “তার অমায়িক ভঙ্গি।
ওকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি স্যুপে মনোযোগী হলাম।
প্রতিবেশী গবগব করে খাবার চিবোতে চিবোতে বললেন,”নতুন এসছেন।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, আজই।”
প্রতিবেশী আরেকটু কথা বলতে চান।
আমার ইচ্ছা ছিল না। কারও সঙ্গেই না।
হঠাতে ইসমাইল সাহেব এসে উপস্থিত।
জাতি ভাই বলে কথা। গন্ধেগন্ধে টের পাওয়া যায় ।
আমি চিনে ফেললাম।
ভদ্রলোক বয়স্ক। তাঁকে দেখলে সমীহ হয়।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি।
ইসমাইল সাহেব আন্তরিক হলেন।
একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন,”আরে কি আশ্চর্য, আপনি উঠছেন কেন? বসেন ,বসেন। আপনার সঙ্গে কখনও দেখা হবে, ভাবিনি। ভাগ্যই বলতে হয়। কুতুব জুনিয়র ছেলে। অনেক বছর ধরে ওকে চিনি। ওই বললো কথাটা, আপনি এখানে এসেছেন। আমারও সুযোগ ঘটলো,দেখা করবার। আমি মোঃ ইসমাইল।”
তিনি পরিচয় দিলেন।
ভদ্রলোকের ষাটোত্তীর্ণ বয়স। মাঝারি আকৃতির। তিনি ফুরফুরে মেজাজের মানুষ। বয়সের কাছে মনের রঙ বুঝি সহজে মুছে যায় না। রোগ শোক কিছুই পারে না সেই রঙ ম্লান করতে। ইসমাইল সাহেবের কেশ, দাঁড়ি, গুম্ফ ও পোশাকের রঙ বলে দিচ্ছে তাঁর মনের রঙে ঔজ্জ্বল্যের অভাব ঘটেনি।
আমি বললাম, “শুনেছি। কুতুব বলেছে।”
তারপর তিনি আমার শরীরের গতিক জানলেন।
আমি সংক্ষেপে বললাম।তিনি বললেন, “এ রোগ বাঁধালেন কি করে?” – – -, “তার মানে?” একটু ইতস্তত করে তিনি বলেন,”আমরা পুরুষ মানুষ। আমাদের কত ধরনের অভ্যেস থাকে।” আমি বুঝে ফেলেছি । হাসলাম। উনি অবাক। আমি বললাম, “ওহো তাই বলেন। বাঁধাইনি। বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে।” উনি একটু অন্যরকম অবাক। আমি তখনও হাসছি। হাসি থামিয়ে বললাম,”কেউ কি ইচ্ছে করে এসব রোগ বাধায়? আমি যে পরিবার থেকে উঠে এসেছি, উচ্চ মধ্যবিত্ত। সেখানে নষ্ট বা নষ্টামির কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর একদিকে খুবই কুচ্ছিত। মাত্র চৌদ্দ বছর থেকে ঊনিশ বয়সের মধ্যে দীর্ঘ পাঁচ বছরের পিতৃমাতৃহীন অজানা পরিবেশের আতঙ্ক, ভালোবাসা, স্নেহ মমতাহীন ভয় ভীতি আমার মধ্যে চেপে বসেছিল। সেটা স্লো পয়জনের মতো ভেতরে কাজ করেছে। আপনিতেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লাম পরে। কবর কবিতাটা পড়েন নি, “হাতেতে যদিও মারিতো না তারা, ঠোঁটেতে মারিতো শত” এমনই আর কি?। সেই সময় অপ্রাপ্ত বয়স আর আবেগি নরম মন। ধাক্কা সামলাবার মতো মন ও শরীরের অবস্থা তৈরি হয়নি। ভেতরে ভেতরে হার্ট ছিদ্র হওয়া ধরলো। তারপর একসময় পঁচিশ,,,, হ্যাঁ পচিশই তো,,,, হার্ট এটাক হয়ে গেছে।” কথা বলতে বলতে কেমন বিভোর হয়ে গেলাম। হঠাৎই মনে হলো তিনি যেন আমার বহুদিনের পরিচিত। আপন কোনো মানুষ।
তিনি বললেন ,”ঠিক বুঝলাম না।” আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। বললাম,” আপনার বুঝে কাজ নেই। ” ইসমাইল সাহেব সিলেটের লোক।আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন।তাঁর অধিকাংশ স্বজনেরা লন্ডনে বসবাস করছে ।
তিনি তর্জনী তুলে দূরের একটা টেবিল দেখালেন আমায়। বললেন,”আমার খাওয়া শেষ। ঐখানে বসেছিলাম।আপনাকে দেখে উঠেছি। “তারপর একাই বকবক করলেন অনর্গল।
তাঁর কথা শুনছি। আমার সুযোগ কম। তবে খারাপ লাগছে না।
একফাঁকে বললাম,”এখেনে পরিবেশটা একেবারেই অন্য রকম। এই যুগে প্রকৃতিতে এখনও বনজ গন্ধ।সেই আদিম যুগের মতো।”
তিনি শুধোলেন,”আগে পাহাড়ে উঠেছেন কখনও ?”
“কেন বলুন তো?”
“এখন সপ্তাহে দুই বা তিনদিন আপনাকে দূর বহুদূর পাহাড় জঙ্গলে ঘুরতে হবে।”
“কারণ আছে হয়তো। বিশুদ্ধ বাতাস——-
তিনি কথা কেড়ে বললেন,”কারণ না ছাই।পাহাড়ে সেই আগের গন্ধ নেই। মাইল জুড়ে খামারিদের শুকুর এবং ঘোড়ার মূত্র নাদির গা ঘিনঘিনে দূষিত দূর্গন্ধ। দূর বাতাস থেকে টের পাবেন বায়ু দূষণ।” আমি হতাশ হলাম,”অনেকের হয়তো জঙ্গল বা জংলী পরিবেশ ভালো লাগে না। আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগছে। দেখার কিছু নাই?”
—, “এখানে দেখার কি আছে?কিচ্ছু না। ঢালের সমান্তরালে কাঠের ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি আর সামনেই খামারে পোষা কতকগুলি ঘোড়া নয়তো ইয়া মোটাসোটা লোমহীন শুকুর কোঁৎকোঁৎ করে ঘোরাফেরা করছে।আর কিছু দেখিনি।”
-“ভালোইতো। অসুন্দরের মধ্যে সুন্দর কে দেখতে পাওয়ার নাম অসাধারণত্ব।”
-“তা বলতে পারেন। আমি ভাই সাধারণ মানুষ। আপনারা কবি সাহিত্যিক,কোথায় কখন যে কি দেখেন? যেখেনে কিছু নেই, সেখেনে ও কিছু না কিছু খুঁজে বের করেন। ডিটেকটিভের মতন। দেখেন কতদিন ভাল লাগে। আমার দম আটকে আছে এই পরিবেশে। বেরোতে পারলে বাঁচি।ভালোয় ভালোয় বাকি দিন কাটলে হয়। আর এমুখো হচ্ছিনা।”
-“তার মানে?”একটু অবাক হই।
তিনি কর গুনে বললেন, “দশদিন পরে আমার পাঠ শেষ।”
-“ওহ্।”আমি নিরাশ।
অতঃপর যেই লাউ, সেই কদু। আমি পুনরায় কথাহীন। ভাবনার বিষণ্ণতা বিস্তৃত হচ্ছে। ‘সময়ে’র মুখ উঁকি দিল হঠাৎ।
আমি খাবার নাড়াচাড়া করছি।
আমাকে অন্যমনস্ক দেখে তিনি বললেন,”খাবার ভালো ? এসবই খেতে হবে, উপায় নেই।”
আমি বললাম,”ঠিক তা না। এতদিন থাকব, সময় আমার ছেলের কথা মনে পড়ছে।”
-“বুঝেছি। এইসব খাবার কিন্তু আমি খেতে পারিনা। মাছেভাতে বাঙালি। ভাত খেতে ইচ্ছা করে।প্রথম প্রথম একদিন শুধু ভাতের খোঁজে, না বলেকয়ে হাঁটতে হাঁটতে দূরের গ্রামে চলে গেছিলাম। তখন রাত। কিছু দোকানপাট আছে। অনেক কিছুই পাওয়া যায়, ভাত পেলাম না, এমনকি চাল ও নেই। আর থাকলেই বা কি, ফুটাতাম কোথায়? এদিকে রাত হয়ে গেছে, ফিরি কি করে? ভাতের চেয়ে তখন ফিরে আসার চিন্তা।গ্রামের লোকজন ভাল ছিল।সেন্ট্রুমের রোগী শুনে,একজন দয়াপরবশ হয়ে গাড়িতে পৌছে দিয়ে গেল।”
আমি শুধোলাম,”আপনার পরিবার বা সদস্যরা আসেন না?”
একটু যেন মুষড়ে পড়লেন তিনি। -“তেমন কই।ছেলে মেয়েরা কাজকর্মে ব্যস্ত। এত পথ।ওদের মায়ের পক্ষে একা একা আসা সম্ভব না।”
-“তাতো ঠিক।”
তিনি বললেন,”পেছনে ঢালের নীচে, চাষিদের ক্ষেতখামার।সুন্দর জায়গা। ছবির মতন সাজানো।দেখলে মনে ধরে। সময় পেলে ওইখানটায় যাবেন। বেড়িয়ে আসবেন।আপনার ভাল লাগবে।সময় ও কাটলো। লিখতে পারবেন।আপনার ভক্ত মানে আমরা আরেকটি বই পাবো। দরকার হলে, আমিই চিনিয়ে দেব। এক বিকেলে আপনাকে নিয়ে যাবো।”
আমি বললাম,”ধন্যবাদ, ঠিক আছে।”
সেন্ট্রুমে রোগীরা এতটাই ব্যস্ত থাকে যে,অপর কারও খোঁজ খবর রাখা বা কথাবার্তার অবসর কম। গ্রুপ ভিন্ন হলে,চাক্ষুষ সাক্ষাত ও মেলে না। অবসরে বা যার যার ফোনে কথা বলা যায়। সেটি আলাদা কথা ।
বাঙালি বুদ্ধি। উভয়ে যুক্তি করে খাবার ঘরের ম্যানেজারকে ডেকে অনুরোধ করলাম, আমাদের খাবার একই টেবিলে দিতে।
ম্যানেজার নামদুটো লিখে নিয়ে গেল।
আমি ব্যস্ত। কুতুব বসে রয়েছে।
আমি উঠে ইসমাইল সাহেবকে বললাম,”চলি,কালকে দেখা হচ্ছে। কুতুবকে ভাত আনতে বলে দিই।ভাতের সঙ্গে কি খাবেন; মাছ না মুরগি?”
তিনি লজ্জায় বললেন, “কি দরকার ।”
আমি জোর দিয়ে বললাম,”ও আগামী কাল এলে নিশ্চয় ভাত আসবে ;সমস্যা না।”
তিনি প্রথম ভেবেছিলেন,হয়তো কুতুবকে ফোন করবো কিন্তু ও এখনও আছে শুনে, তাঁর বিস্ময়ের পালা।
-“কুতুব তবে যায়নি? ”
-“না, শেষ বাসটা ধরবে।”
-“কেন নিষেধ করেননি।এই পথে দিনে দিনে যাওয়া ভাল।”
-“ওই শুনলো না।”
-“বুঝতে পারছি, মায়া।আপনি ভাগ্যবতী।”
-“অনেকেই তাই বলেন।আমার জন্য ওর অসাধারণ আবেগের ভালবাসা। আল্লাহর করুণা বাদে হয়তো এই বেঁচে যাওয়া, বেঁচে থাকাটা ওরই কৃতিত্ব । আমাদের প্রত্যেকের ভেতর বসবাস করে একজন আমি।সেই আমি’র অনুভূতি অনুভবে থাকে ভালবাসা।সামান্য কারণ-অকারণে ভালবাসা বাঁচে,ভালবাসা মরে।আমরা প্রত্যেকেই নিজের মানুষের কাছ থেকে একটু উষ্ণতা,একটু স্পর্শ, আদর,ভালবাসার ভরসায় বেঁচে থাকি।অনেক রোগ শোক, দুঃখ কষ্টের মধ্যে ও বেঁচে থাকার স্বাদ জাগে।আমার জন্য কুতুবের অনেক ত্যাগ,প্রগাঢ় ভালবাসা, মহানুভবতা,আবেগ অনুভূতি,বিশ্বাসের আস্হা অপরিসীম।আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত।”
-“কুতুব আপনার মুখের “হ্যাঁ”শব্দটি শোনার জন্য ,অনেক বছর প্রতীক্ষা করেছে।প্রায় একযুগ।অতটা বছর,,,, একটা পুরুষ ছেলের পক্ষে অসম্ভব ।”
একটু লজ্জা, একটু আবেগ একটুখানি গর্বে বোধ হয় আমি মৃদু হাসি। বললাম -“হ্যাঁ লম্বা সময়। অনেকেই ভালবাসার মানুষের জন্য প্রতীক্ষা করেন।প্রতীক্ষার উল্টো পিঠে সাফল্য না ব্যর্থতা,কি আছে জানা না থাকলেও প্রতীক্ষা করেন।আমি ও করেছি,ভুলের অবসানের জন্য। অপেক্ষা না করলে হয়তো অসুখটা বাঁধতো না। আমার জীবনে কোনো পাপ,ভন্ডামি,মিথ্যে ছিল না।অল্পবয়সী আবেগ আর বুদ্ধির অপরিপক্কতা এর কারণ। ঊনিশের পরে আরও ছয় বছর। কাউকে ঠকাতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না।হয়তো তাই মনের ভাটি নদী,জোয়ার আসেনি।সবাই সত্য বলেন না,ভয় পান।প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনো কারণে খারাপ সময় আসে। আগেই বলেছি, খুবই অল্পবয়সে অসম্ভব রকম খারাপ একটা সময় কেটেছে। সেটা আমার জীবনের কালসময়। অসুখটা তখনকার ।রক্তের গরম। কিছুদিন চুপেচাপে ছিল।বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার আগে প্রকাশ হয়ে পড়ে। তারপর কত ছোটাছুটি,,,,,,,ঢাকা -কোলকাতা-ঢাকা, ,,,,,,,,,। ভাল হওয়া আর হলোনা। একলা নিজের ভার বইতে আমি অক্ষম হই। অবশেষে সকল প্রতীক্ষা শেষে দেখলাম,কুতুবের প্রশস্ত হৃদয় দুয়ার তখনও খোলা। ও খুশি মনে অসুস্থ, ভঙ্গুর এই আমার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। ভালবাসা যে সস্তা না ,অতি দামী এক অমূল্য ধন।সবাই এর মূল্য বোঝেন না।সাধারণ জগতের হওয়া ছাড়া যে কুতুবের কিছু গুণের কারণে আমার কাছে ও অসাধারণ। ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সচ্চরিত্র,সত্যবাদি,বিণয় এবং ধৈর্য্য । তথাকথিত সুদর্শন, শিক্ষিত অনেকের মাঝে এই গুণের অভাব প্রকট।গর্ব করে বলতে পারি,আমি ঠকিনি। আমার কাছে কুতুবকে এর বেশি আর কিছু হতে হয়নি। ”
ভদ্রলোক মুগ্ধহাস্যে বললেন,”বাহ্ চমৎকার।বড়ো মূল্যবান কথা বলেছেন।”
-“ওর জন্য দোয়া করবেন,এবং দয়াময় আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে এইভাবে রাখেন।”
-“নিশ্চয়ই।”
তিনিও উঠলেন।বললেন,”আপনার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আপনাকে আটকানো ঠিক হচ্ছে না। তারপর যেতে যেতে বললেন,আপনি নিজেই অত্যন্ত সুন্দরী, শ্রী লাবণ্য, কথাবার্তা আকর্ষণীয়। আমি বা আমরা যা শুনতাম তারও চেয়ে বেশি। অনেকটা হিন্দি ছবির,,,,,,, আমি ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি। বললাম, “বাদ দিন। ও সব অনেক বছর আগের কথা।” – -, “আপনি ওরকমই। আচ্ছা থাক,,,,,,,,,, কুতুবকে সালাম বলবেন।”
-“জ্বী।”
খাবার ঘরের দরজা থেকে তিনি অন্য পথে হাঁটা ধরলেন।
চলবে ——-